আরিফ মেহমুদ ॥ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ফের সংগঠিত হচ্ছে চরমপন্থি সংগঠনগুলো। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা সহ বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নতুনভাবে সংগঠিত হচ্ছে ৯টি চরমপন্থি সংগঠন। ’৯৬ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চরমপন্থিদের আত্মসমর্পণ এবং র্যাব-পুলিশের অব্যাহত অভিযান ও ক্রসফায়ারে শীর্ষ চরমপন্থি নেতারা নিহত হওয়ায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে চরমপন্থি সংগঠনগুলো। শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ ক্রসফায়ারে নিহত হয়? আরেকটি অংশ আত্মগোপন করে পাশ্বর্র্বতী দেশের সীমান্ত এলাকায়। তবে দেশের ভেতরে অক্ষত থেকে যায় তাদের বিশাল ক্যাডার বাহিনী ও অস্ত্রভাণ্ডার। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, চরমপন্থিদের অভিযানগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে একে-৪৭ রাইফেল সহ বড় বড় অস্ত্র। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে র্যাব-পুলিশের হাতে একে-৪৭ রাইফেল সহ চরমপন্থিরা গ্রেপ্তার হয়েছে অন্যদিকে ক্রস ফায়ারে নিহত চরমপন্থিদের কাছ থেকে র্যাব-পুলিশের অস্ত্র উদ্ধার বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। সূত্রমতে এখনও ওই এলাকার চরমপন্থিদের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গেছে বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার পাশাপাশি আছে তাদের ক্যাডার বাহিনী। বিগত এক বছরে দেখা গেছে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলায় র্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে প্রায় অর্ধশত চরমপন্থি ক্যাডার, ঘটেছে কয়েক ডজন চরমপন্থি হামলা। বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে এক শ’র বেশি। দিনে দিনে চরমপন্থিরা আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সীমান্ত গলিয়ে আসছে অস্ত্র। সে অস্ত্র পৌঁছে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে চরমপন্থি ক্যাডারদের হাতে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থি সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখন প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর হাতে। ওই অঞ্চলে প্রচলন আছে, এখানে দিনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাতে চরমপন্থি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার কোনটাতেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি তাদের পূর্ণাঙ্গ জেলা-উপজেলা কমিটি গঠন করতে পারে না। কমিটি গঠনের সময় দলের পদ-পদবি উল্লেখ করে নামের তালিকা দেয়া হয় চরমপন্থিদের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেক নেতাই গোপনে চরমপন্থিদের নেতৃত্ব দেন। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা জানলেও তাদের কিছু করার থাকে না। র্যাব-পুলিশের কাছে ওই সব সন্ত্রাসীর অপরাধ কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ ফিরিস্তি থাকার পরও তাদেরকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনার একাধিক চরমপন্থি সন্ত্রাসীকে দলের পদ-পদবি দিয়ে দলে নেয়া হয়েছে। র্যাব-পুলিশের তালিকাভুক্ত ওই সন্ত্রাসীরা এখন দলীয় পরিচয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্রমতে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের গডফাদাররা মাঠ দখল করতে আগেভাগেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চরমপন্থিদের সংগঠিত করছে। দীর্ঘদিন ধরে দেখা গেছে, চরমপন্থিরা তাদের সংগঠিত হওয়ার খবর জানান দেয় যে কোন বড় ধরনের একটি হত্যা অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে। গত ২৮শে আগস্ট কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার আমবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ও তার দুই সঙ্গীকে হত্যার মধ্য দিয়ে চরমপন্থিরা তাদের নবরূপে সংগঠিত হওয়ার খবর জানান দিয়েছে বলে মনে করছেন ওই এলাকার সচেতন মহল।
সূত্র জানায়, চরমপন্থিরা বর্তমান পর্যায়ে সংগঠিত হতে জোর দিচ্ছে নারী সংগঠনের ওপর। র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত চরমপন্থি নেতাদের স্ত্রীরা মাঠে নেমে ক্যাডারদের সংগঠিত করছে। এছাড়াও কৌশল বদলে চরমপন্থিরা এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করছে মিডিয়ার পরিচয়ধারী কিছু লোককে। তাদের দায়িত্ব, র্যাব-পুলিশ ও সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের গতিবিধি আগেভাগেই চরমপন্থিদের জানিয়ে দেয়া। একটি গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে, কুষ্টিয়াতে তিনজন কথিত সাংবাদিক এখন কাজ করছে চরমপন্থিদের মিডিয়া উইংয়ে। তাদের মাধ্যমে চরমপন্থিদের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের যোগসূত্র গড়ে উঠছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একাধিক জেলা থেকে জানা গেছে, প্রতিহিংসা আর চাঁদাবাজিতে মেতে উঠেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের একাধিক সংগঠন। পলাতক ক্যাডাররা এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে। দলে রিক্রুট করা হচ্ছে কিশোর, যুবক ও মহিলাদের। চরমপন্থি সংগঠনের নিহত নেতাদের স্ত্রী ও স্বামী পরিত্যক্ত মহিলাদের কাজে লাগানো হচ্ছে। বিস্তীর্ণ এলাকার অধিবাসীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায় ৯টি চরমপন্থি সংগঠনসহ অন্তত শতাধিক গ্যাং-গ্রুপে রয়েছে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি অস্ত্রধারী। এদের অনুসারী রয়েছে আরও দেড় হাজারের মতো। এগুলো হচ্ছে- পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), জনযুদ্ধ, মাওবাদী কংগ্রেস, লালপতাকা, শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, গণবাহিনী, বাংলার কমিউনিস্ট ও দুখু বাহিনী। এছাড়াও সেভেন স্টার, ফোর স্টার, মান্নান বাহিনী উল্লেখযোগ্য। নানা নামে নানা মতে গড়ে ওঠা চরমপন্থি দলগুলো পরস্পরবিরোধী সংঘাতের কারণে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, মেহেরপুরের গাংনী, ঝিনাইদহের শৈলকুপা, হরিণাকুণ্ডুু সদর, কুষ্টিয়ার ইবি, সদর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, মাগুরার শ্রীপুর, নড়াইল, রাজবাড়ীর পাংশা, খুলনার ফুলতলা, সাতক্ষীরার চুকনগর, যশোরের কেশবপুর, শার্শা, ঝিকরগাছা এলাকায় চরমপন্থিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশের তালিকায় নাম নেই এমন সব যুবক-যুবতী আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত মোস্ট ওয়ানটেডের তালিকায় রয়েছে যারা তাদের মধ্যে মেহেরপুরের গাংনীর বেতবাড়িয়ার মতি মোল্লা, মকবুল চেয়ারম্যান, সুমন, মহিলা নেত্রী বাথান পাড়ার কুমকুম, কুষ্টিয়ার শাহিন-মুকুল, দৌলতপুরের ফারুক চেয়ারম্যান, বিপুল চৌধুরী এবং পিচ্চি মনিরুল, মহিলা ক্যাডার সুমিসহ ১৬ জন। কুষ্টিয়ার গণমুক্তি ফৌজের শাহীন, মুকুল বর্তমানে আছে ভারতের কারাগারে। এলাকার চরমপন্থিদের সংগঠিত করতে ভারত-বাংলাদেশ আসা যাওয়া করছে গণবাহিনীর আনোয়ার হোসেন আনু, গণমুক্তি ফৌজের লিপ্টন ও জাসদ গণবাহিনীর কালু। কুষ্টিয়ায় মহিলা চরমপন্থির সংখ্যা বেশি। ইতিমধ্যে কুষ্টিয়ায় অন্তত একডজন মহিলা চরমপন্থি ধরা পড়েছে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে বলে একজন পুলিশ অফিসার জানান।
ঝিনাইদহে পুরনোদের মধ্যে কুদ্দুস, দেবু, বিধানের নাম রয়েছে পুলিশের তালিকায়। এছাড়াও বাইরের সন্ত্রাসীরাও এ অঞ্চলে অবস্থান করছে। একটি গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। গ্রাম্য বিবাদ, ক্ষমতাসীন দলের নিপীড়ন, পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়া নানা ইস্যুতে নতুন-পুরনো মিলিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে নতুন নতুন মুখ যোগ হচ্ছে এবং ভেতরে ভেতরে শক্তিশালী হচ্ছে তারা। চরমপন্থি দল চাঙ্গা করতে শক্তিশালী মহিলা সিন্ডিকেট মাঠে রয়েছে। নয়া কৌশল হিসেবে চরমপন্থিদের কয়েকটি সংগঠন মহিলাদের কাজে লাগাচ্ছে। স্বজন হত্যার প্রতিশোধ আর সংসার নির্বাহ করতে ঝুঁকি জেনেও অস্ত্রধারী দলে যোগ দিচ্ছে মহিলারা। বর্তমানে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুলিশ ক্যাম্পগুলোতে ছদ্মবেশে মহিলারা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা পুলিশের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তার। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দেড়শতাধিক চরমপন্থি বন্দুক যুদ্ধ ও গণপিটুনিতে নিহত হয়। অনেকে আটক রয়েছে কারাগারে। কারাগারে থাকা দাদাদের পরামর্শে জামিন প্রাপ্তদের সঙ্গে নাতি চরমপন্থিরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
২০১২-এর বিগত ছয় মাসে অস্ত্রের যে ক্ষুদ্রাংশ ধরা পড়েছে তার মধ্যে ৪ঠা জানুয়ারি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার আড়পাড়া গ্রাম থেকে একটি এলজি শাটারগান ও এক রাউন্ড গুলিসহ নজিবুল (৩০) নামের এক চরমপন্থি সন্ত্রাসীকে আটক করে গাংনী থানা পুলিশ। সে চরমপন্থি সংগঠন লাল পতাকার তপন মালিথা গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। ১৫ই জানুয়ারি গাংনী থেকে দু’টি তাজা বোমা উদ্ধার করে র্যাব। ২৮শে জানুয়ারি শুক্রবার দিবাগত মধ্য রাতে মেহেরপুরে পৃথক দু’টি স্থান থেকে ৪টি বোমা, ১টি এলজি শাটারগান ও ১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। ৮ই ফেব্রুয়ারি চরমপন্থি সংগঠন বিপ্লবি কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) জনযুদ্ধের আঞ্চলিক নেতা মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের দাউদ হোসেন (৪৫) ও তার সহযোগী খলিল উদ্দীন (৩৫)-কে আটক করে র্যাব। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে ১টি এলজি শাটারগান, ২টি বোমা, ২টি তলোয়ারও উদ্ধার করা হয়। ১২ই ফেব্রুয়ারি র্যাব-পুলিশ যৌথ অভিযানে মেহেরপুরের গাংনী থেকে অস্ত্র গুলি ও বোমাসহ ৪ চরমপন্থিকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে ২টি এলজি শাটারগান, ২ রাউন্ড গুলি, ৪টি তাজা বোমা ও ২টি ধারালো অস্ত্র (রামদা ও ছুরি) উদ্ধার করা হয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর গাংনী উপজেলার কাজিপুর গ্রাম থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৪টি শক্তিশালী তাজা বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। ২৪শে ফেব্রুয়ারি গাংনী থেকে অস্ত্র, বোমা, গুলিসহ এক চরমপন্থিকে আটক করে র্যাব ৯ই মার্চ একই দিন গাংনী উপজেলার বেতবাড়ীয়া গ্রাম থেকে ১টি এলজি শাটারগান, ১ রাউন্ড গুলিসহ উকিল মিয়া নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঝিনাইদহতে বর্তমানে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), জনযুদ্ধ, জাসদ গণবাহিনী, হক গ্রুপের ক্যাডারদের তৎপরতা রয়েছে। চাঁদাবাজি, রাহাজানি, মানুষ হত্যাই যেন চরমপন্থিদের এখন বড় কাজ। এ অঞ্চলের সচেতন পর্যবেক্ষণ মহলের দাবি, শুধু চরমপন্থি নেতারা নির্মূল হলেই এ এলাকা থেকে চরমপন্থি দূর হবে না। স্থায়ীভাবে চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বন্ধ করতে হলে আগে দরকার এদের মদতদাতাদের খুঁজে বের করা। তাদেরকে খুঁজে নির্মূল না করা গেলে চরমপন্থিদের নির্মূল কোনভাবেই সম্ভব হবে না। গত মাসের গোড়ার দিকে ঝিনাইদহে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে গণমুক্তি ফৌজের চার ক্যাডার। জানা গেছে তারা নতুন করে দল সংগঠিত করতে মাঠে নেমেছিল। যশোরে একের পর এক ঘটছে গোপন হত্যাকাণ্ড। রাজনৈতিক অস্থিরতা কাজে লাগিয়ে যশোরের চরমপন্থিরা ফের তৎপর হয়ে উঠেছে নিজ এলাকায়। রাজনৈতিক নেতাদের ভাড়াটে খুনি হিসেবে একের পর এক ঘটিয়ে চলছে হত্যাকাণ্ড। ওই সব চরমপন্থিদের আশ্রয় দিচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সূত্রমতে চরমপন্থিদের নতুন করে সংগঠিত করতে খরচ যোগাচ্ছে কতিপয় নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক নেতা।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনার একাধিক চরমপন্থি সন্ত্রাসীকে দলের পদ-পদবি দিয়ে দলে নেয়া হয়েছে। র্যাব-পুলিশের তালিকাভুক্ত ওই সন্ত্রাসীরা এখন দলীয় পরিচয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্রমতে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের গডফাদাররা মাঠ দখল করতে আগেভাগেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চরমপন্থিদের সংগঠিত করছে। দীর্ঘদিন ধরে দেখা গেছে, চরমপন্থিরা তাদের সংগঠিত হওয়ার খবর জানান দেয় যে কোন বড় ধরনের একটি হত্যা অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে। গত ২৮শে আগস্ট কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার আমবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ও তার দুই সঙ্গীকে হত্যার মধ্য দিয়ে চরমপন্থিরা তাদের নবরূপে সংগঠিত হওয়ার খবর জানান দিয়েছে বলে মনে করছেন ওই এলাকার সচেতন মহল।
সূত্র জানায়, চরমপন্থিরা বর্তমান পর্যায়ে সংগঠিত হতে জোর দিচ্ছে নারী সংগঠনের ওপর। র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত চরমপন্থি নেতাদের স্ত্রীরা মাঠে নেমে ক্যাডারদের সংগঠিত করছে। এছাড়াও কৌশল বদলে চরমপন্থিরা এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করছে মিডিয়ার পরিচয়ধারী কিছু লোককে। তাদের দায়িত্ব, র্যাব-পুলিশ ও সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের গতিবিধি আগেভাগেই চরমপন্থিদের জানিয়ে দেয়া। একটি গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে, কুষ্টিয়াতে তিনজন কথিত সাংবাদিক এখন কাজ করছে চরমপন্থিদের মিডিয়া উইংয়ে। তাদের মাধ্যমে চরমপন্থিদের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের যোগসূত্র গড়ে উঠছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একাধিক জেলা থেকে জানা গেছে, প্রতিহিংসা আর চাঁদাবাজিতে মেতে উঠেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের একাধিক সংগঠন। পলাতক ক্যাডাররা এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে। দলে রিক্রুট করা হচ্ছে কিশোর, যুবক ও মহিলাদের। চরমপন্থি সংগঠনের নিহত নেতাদের স্ত্রী ও স্বামী পরিত্যক্ত মহিলাদের কাজে লাগানো হচ্ছে। বিস্তীর্ণ এলাকার অধিবাসীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায় ৯টি চরমপন্থি সংগঠনসহ অন্তত শতাধিক গ্যাং-গ্রুপে রয়েছে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি অস্ত্রধারী। এদের অনুসারী রয়েছে আরও দেড় হাজারের মতো। এগুলো হচ্ছে- পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), জনযুদ্ধ, মাওবাদী কংগ্রেস, লালপতাকা, শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, গণবাহিনী, বাংলার কমিউনিস্ট ও দুখু বাহিনী। এছাড়াও সেভেন স্টার, ফোর স্টার, মান্নান বাহিনী উল্লেখযোগ্য। নানা নামে নানা মতে গড়ে ওঠা চরমপন্থি দলগুলো পরস্পরবিরোধী সংঘাতের কারণে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, মেহেরপুরের গাংনী, ঝিনাইদহের শৈলকুপা, হরিণাকুণ্ডুু সদর, কুষ্টিয়ার ইবি, সদর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, মাগুরার শ্রীপুর, নড়াইল, রাজবাড়ীর পাংশা, খুলনার ফুলতলা, সাতক্ষীরার চুকনগর, যশোরের কেশবপুর, শার্শা, ঝিকরগাছা এলাকায় চরমপন্থিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশের তালিকায় নাম নেই এমন সব যুবক-যুবতী আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত মোস্ট ওয়ানটেডের তালিকায় রয়েছে যারা তাদের মধ্যে মেহেরপুরের গাংনীর বেতবাড়িয়ার মতি মোল্লা, মকবুল চেয়ারম্যান, সুমন, মহিলা নেত্রী বাথান পাড়ার কুমকুম, কুষ্টিয়ার শাহিন-মুকুল, দৌলতপুরের ফারুক চেয়ারম্যান, বিপুল চৌধুরী এবং পিচ্চি মনিরুল, মহিলা ক্যাডার সুমিসহ ১৬ জন। কুষ্টিয়ার গণমুক্তি ফৌজের শাহীন, মুকুল বর্তমানে আছে ভারতের কারাগারে। এলাকার চরমপন্থিদের সংগঠিত করতে ভারত-বাংলাদেশ আসা যাওয়া করছে গণবাহিনীর আনোয়ার হোসেন আনু, গণমুক্তি ফৌজের লিপ্টন ও জাসদ গণবাহিনীর কালু। কুষ্টিয়ায় মহিলা চরমপন্থির সংখ্যা বেশি। ইতিমধ্যে কুষ্টিয়ায় অন্তত একডজন মহিলা চরমপন্থি ধরা পড়েছে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে বলে একজন পুলিশ অফিসার জানান।
ঝিনাইদহে পুরনোদের মধ্যে কুদ্দুস, দেবু, বিধানের নাম রয়েছে পুলিশের তালিকায়। এছাড়াও বাইরের সন্ত্রাসীরাও এ অঞ্চলে অবস্থান করছে। একটি গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। গ্রাম্য বিবাদ, ক্ষমতাসীন দলের নিপীড়ন, পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়া নানা ইস্যুতে নতুন-পুরনো মিলিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে নতুন নতুন মুখ যোগ হচ্ছে এবং ভেতরে ভেতরে শক্তিশালী হচ্ছে তারা। চরমপন্থি দল চাঙ্গা করতে শক্তিশালী মহিলা সিন্ডিকেট মাঠে রয়েছে। নয়া কৌশল হিসেবে চরমপন্থিদের কয়েকটি সংগঠন মহিলাদের কাজে লাগাচ্ছে। স্বজন হত্যার প্রতিশোধ আর সংসার নির্বাহ করতে ঝুঁকি জেনেও অস্ত্রধারী দলে যোগ দিচ্ছে মহিলারা। বর্তমানে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুলিশ ক্যাম্পগুলোতে ছদ্মবেশে মহিলারা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা পুলিশের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তার। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দেড়শতাধিক চরমপন্থি বন্দুক যুদ্ধ ও গণপিটুনিতে নিহত হয়। অনেকে আটক রয়েছে কারাগারে। কারাগারে থাকা দাদাদের পরামর্শে জামিন প্রাপ্তদের সঙ্গে নাতি চরমপন্থিরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
২০১২-এর বিগত ছয় মাসে অস্ত্রের যে ক্ষুদ্রাংশ ধরা পড়েছে তার মধ্যে ৪ঠা জানুয়ারি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার আড়পাড়া গ্রাম থেকে একটি এলজি শাটারগান ও এক রাউন্ড গুলিসহ নজিবুল (৩০) নামের এক চরমপন্থি সন্ত্রাসীকে আটক করে গাংনী থানা পুলিশ। সে চরমপন্থি সংগঠন লাল পতাকার তপন মালিথা গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। ১৫ই জানুয়ারি গাংনী থেকে দু’টি তাজা বোমা উদ্ধার করে র্যাব। ২৮শে জানুয়ারি শুক্রবার দিবাগত মধ্য রাতে মেহেরপুরে পৃথক দু’টি স্থান থেকে ৪টি বোমা, ১টি এলজি শাটারগান ও ১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। ৮ই ফেব্রুয়ারি চরমপন্থি সংগঠন বিপ্লবি কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) জনযুদ্ধের আঞ্চলিক নেতা মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের দাউদ হোসেন (৪৫) ও তার সহযোগী খলিল উদ্দীন (৩৫)-কে আটক করে র্যাব। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে ১টি এলজি শাটারগান, ২টি বোমা, ২টি তলোয়ারও উদ্ধার করা হয়। ১২ই ফেব্রুয়ারি র্যাব-পুলিশ যৌথ অভিযানে মেহেরপুরের গাংনী থেকে অস্ত্র গুলি ও বোমাসহ ৪ চরমপন্থিকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে ২টি এলজি শাটারগান, ২ রাউন্ড গুলি, ৪টি তাজা বোমা ও ২টি ধারালো অস্ত্র (রামদা ও ছুরি) উদ্ধার করা হয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর গাংনী উপজেলার কাজিপুর গ্রাম থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৪টি শক্তিশালী তাজা বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। ২৪শে ফেব্রুয়ারি গাংনী থেকে অস্ত্র, বোমা, গুলিসহ এক চরমপন্থিকে আটক করে র্যাব ৯ই মার্চ একই দিন গাংনী উপজেলার বেতবাড়ীয়া গ্রাম থেকে ১টি এলজি শাটারগান, ১ রাউন্ড গুলিসহ উকিল মিয়া নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঝিনাইদহতে বর্তমানে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), জনযুদ্ধ, জাসদ গণবাহিনী, হক গ্রুপের ক্যাডারদের তৎপরতা রয়েছে। চাঁদাবাজি, রাহাজানি, মানুষ হত্যাই যেন চরমপন্থিদের এখন বড় কাজ। এ অঞ্চলের সচেতন পর্যবেক্ষণ মহলের দাবি, শুধু চরমপন্থি নেতারা নির্মূল হলেই এ এলাকা থেকে চরমপন্থি দূর হবে না। স্থায়ীভাবে চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বন্ধ করতে হলে আগে দরকার এদের মদতদাতাদের খুঁজে বের করা। তাদেরকে খুঁজে নির্মূল না করা গেলে চরমপন্থিদের নির্মূল কোনভাবেই সম্ভব হবে না। গত মাসের গোড়ার দিকে ঝিনাইদহে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে গণমুক্তি ফৌজের চার ক্যাডার। জানা গেছে তারা নতুন করে দল সংগঠিত করতে মাঠে নেমেছিল। যশোরে একের পর এক ঘটছে গোপন হত্যাকাণ্ড। রাজনৈতিক অস্থিরতা কাজে লাগিয়ে যশোরের চরমপন্থিরা ফের তৎপর হয়ে উঠেছে নিজ এলাকায়। রাজনৈতিক নেতাদের ভাড়াটে খুনি হিসেবে একের পর এক ঘটিয়ে চলছে হত্যাকাণ্ড। ওই সব চরমপন্থিদের আশ্রয় দিচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সূত্রমতে চরমপন্থিদের নতুন করে সংগঠিত করতে খরচ যোগাচ্ছে কতিপয় নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক নেতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন