আরিফ মেহমুদ ॥ কুষ্টিয়ায় একের পর এক বিষাক্ত স্পিরিট ট্রাজেডীতে অনাকাংখিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও একেবারে নিশ্চুপ রয়েছে স্পিরিট ও মাদকের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধকারী সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশ প্রশাসনের অধিকর্তারা। মাদকদ্রব্যে ভয়াবহতা প্রতিরোধ ও দমনে এদের আবার কারোর রয়েছে প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব আবার কারো যানবাহন লোকবল দুটোরই অভাব। অধিকর্তা দের অভ্যান্তরিন সমস্যা যাই হোক না কেন অবৈধ মাদকদ্রব্য বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে প্রয়োনীয় অভিযানের অভাবেই বিষাক্ত স্পিরিট পানে অনাকাংখিত মৃত্যুর খবর কুষ্টিয়ার জন্য নতুন কোন খবর নয়। এদের কাছে এসব মৃত্যু যেন মৃত্যুই নয়। এটি অতি পরিচিত চিত্র। কোন স্বজনহারা নিকট জনের হৃদয় বিদারক হাহাকার। সারা দিনের কর্মব্যস্ত যে মানুষটি হাজারো লোকের ভিড়ে যার পদাচারণা, নিজের অভ্যেসগত কারনেই বিষাক্ত স্পিরিট পান, তার পর রাতেই সেই মানুষটির অস্বাভাবিক ও অনাকাংক্ষিত মৃত্যুর সংবাদ যেন গোটা পরিবারকে ভাবিয়ে তুলছে নিত্যদিন। চলতি ২০১২ সালের ২৭ অক্টোবর ঈদের দিন থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কুষ্টিয়ার কুমারখালি, দৌলতপুর ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ৩জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার পল্লীতে ঈদের দিন বিষাক্ত মদ পান করে একজনের মৃত্যু হয়। মৃত্যের অপর সঙ্গী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের মধুপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের কেরামত আলি শেখের ছেলে লিয়াকত (৩৮) ও একই গ্রামের মৃত জলিল শেখের ছেলে মহম্মদ (৪০) ঈদের দিন বিষাক্ত মদ পান করলে চরম অসুস্থ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পরের দিন রবিবার ভোরে লিয়াকত মারা যায়। অন্যদিকে সংকটাপন্ন মহম্মদকে তার আত্মীয়-স্বজন কুমারখালি উপজেলা স্বাস্থ্য-কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। উল্লেখ্য, কুমারখালি শহরে সরকারি লাইসেন্সকৃত মদ বিক্রির দোকানে অবাধে যার-তার কাছে মদ বিক্রি হয়ে আসছে। সরকারি নিয়মানুযায়ি লাইসেন্সকৃত খোরদের নিকট মদবিক্রির নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছেনা। গত এক বছরের কুমারখালিতে বিষাক্ত মদ পানে ৪জনের মৃত্যু হয়। গত ৩০ অক্টোবর সদর উপজেলার হরিণারয়ণপুর এলাকার গোবিন্দর ছেলে গৌতম বিশ্বাস (৩২) বিষাক্ত স্পিরিট পানে মারা যায়। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বিষাক্ত স্পিরিট পান করে রেজাউল মল্লিক (৩৫) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও একই ঘটনায় কামাল নামে এক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত ৩১ অক্টোবর বুধবার রাতে আল্লারদর্গা বাজারে তারা দু’জনে স্পিরিট পান করে বাড়ি ফেরার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রেজাউল মল্লিককে কুষ্টিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাত ১২টার দিকে তিনি মারা যান। রেজাউল মল্লিক পুরাতন আমদহ গ্রামের রহিম মল্লিকের ছেলে। উল্লেখ্য ২০০১ সালে রমজান মাসে কুষ্টিয়া শহরের কুঠিপাড়ায় বিষাক্ত স্পিরিট পানে ১৬ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু দিয়ে শুরু হয়ে গত ১০ বছরের কুষ্টিয়ার ৬ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় উপজেলায় ৩৮ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার দৌলত পুরে ৩ দিনে ৩ জনের মৃত্যু ঘটে এবং শহরের চর আমলা পাড়ায় মারা যায় আরো ১ জন। এছাড়াও আরো ৭ জন স্পিরিটের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। অপর দিকে দৌলতপুর কলেজ পাড়ার খবির উদ্দিন ওরফে ভ্যাগল (৫২) নামের এক ব্যাক্তি ঈদের দিন রাতে উপজেলার তারাগুনিয়া বাজার থেকে বিষাক্ত মদ পান করেন। এর পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই দিন তাকে দৌলতপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ১৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১ টায় তার মৃত্যু হয়। সংসার তথা তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনাক্ষম মানুষটির এভাবে অসময়ে অনাকাংখিত মৃত্যুর দায়িত্ব নেবে কে? এমন প্রশ্ন অতিসম্প্রতি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ঘটে যাওয়া বিষাক্ত স্পিরিট ট্রাজেডীতে মৃত্যু বরণকারী যুবলীগ কর্মী পিনু সরদারের পরিবারসহ একাধিক পরিবারের স্বজনদের। এসব ঘটনায় অভিযুক্ত করে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অবৈধ বিষাক্ত স্পিরিট বিক্রেতাদের মাঝে মধ্যে গ্রেফতার করলেও প্রত্যক্ষ স্বাক্ষীর অভাবে তারা খুব তাড়াতাড়ী বেরিয়েও আসছে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে। কুষ্টিয়া মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আইউব আলী মিয়া জানান,এ্যালকোহল বা স্পিরিট অবাধে বিক্রির কোন লাইসেন্স দেয়া হয়না বা নেই। তবে ওষুধ প্রতিষ্ঠান সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে স্পিরিট ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। হোমিও চিকিৎসকদের ৭জন, শিল্পে ২ এবং ল্যাবরেটরি’র জন্য ২টি করে সর্বমোট জেলায় ১১টি প্রতিষ্ঠানকে স্পিরিট ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স প্রদান করেছেন। বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছে-কুষ্টিয়া শহরের ন্যাশনাল হোমিও হল, বেঙ্গল ল্যাবরেটরি, ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি, কুষ্টিয়া চিনিকল, শিলাইদহ ডেইরী ফ্যাক্টরী, কুষ্টিয়ার এন এস রোডের হানিম্যান হোমিও হল, ভেড়ামারার বাবর হোমিও ক্লিনিক, খালেদ হোমিও হল, কুমারখালীর কেণ্ট হোমিও ক্লিনিক, সান্দিয়ারার হানিম্যান হোমিও ফার্মেসী ও তন্নী হোমিও ফার্মেসী। এসব প্রতিষ্ঠান বছরে সর্বোচ্চ ৭৭২ লিটার ও সর্বনিম্ন ১১ লিটার রেক্টিফাইড স্পিরিট উত্তোলন করতে পারবে। ওই সুত্রের দাবী এসব বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্তরা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বরাদ্দ বাদেও এখতিয়ার বহির্ভুতভাবে কোন প্রকার অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ড্রাগ)-এর অনুমোদনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাজার হাজার লিটার হোমিও ওষুধের কাচামাল (ইথানল) হিসেবে রেক্টিফাইড স্পিরিট উত্তোলণ করে নামমাত্র হোমিও চিকিৎসক এবং অবৈধ স্পিরিট, মদ বিক্রেতাদের কাছে দিয়ে মাদকের ভয়াবহতা ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে রেক্টিফাইড স্পিরিট উত্তোলন বা বরাদ্দ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ড্রাগ) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ক্ষমতা ও অগ্রাধিকারের টানাটানিতে বিপর্যস্ত ও নিয়ন্ত্রণহী হয়ে পড়েছে জেলার বিষাক্ত স্পিরিট ট্রাজেডি দমন কার্যক্রম। কোন প্রকার অনুমোদন ছাড়াই এসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাজার হাজার লিটার রেক্টিফাইড স্পিরিট উত্তোলণ বন্ধে বা নিয়ন্ত্রণ নিতে অধিকার ও ক্ষমতা নিয়ে এ দুই অধিদপ্তরের মধ্যে মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অতিরিক্ত রেক্টিফাইড স্পিরিট উত্তোলণ চলছে অবাধে দেখার কেউ নেই। অপরদিকে প্রায় প্রতিদিনই সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে দেশে শত শত লিটার স্পিরিট ও ভারতীয় মদ প্রবেশ হচ্ছে বলে জানা যায়। এসব স্পিরিট পানে অকালে ঝড়ে পড়ছে যুব সমাজসহ পরিবারের একমাত্র উপার্জনাক্ষম মানুষটি। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক জানায়, মাদক দ্রব্য অফিস কর্মকর্তা মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর ভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। যত্র তত্র মাদক বিক্রি যাতে না হয় সে ব্যাপারে টহল দেয়া হবে। এব্যাপারে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহাম্মেদ জানিয়েছেন যারাই স্পিরিট কিংবা মদ ব্যাবসার সাথে জরিত থাকেন না কেন লাইসেন্সধারীদের বাদ দিয়ে যার-তার কাছে মদ বিক্রি করলে তাদেরকে ছাড় দেয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে আয়োজিত জেলা আইনশৃংখলা কমিটির সাধারণ সভায় সভাপতির বক্তব্যে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক বলেন, কুষ্টিয়া জেলাকে সম্পূর্ন মাদক মুক্ত রাখতে ও মাদকদ্রব্যের ভয়াবহতা প্রতিরোধে জেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে কঠোর হস্তে চোরাচালান বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মাদকদ্রব্যের ভয়াবহতা প্রতিরোধে সমাজের সব শ্রেণী -পেশার মানুষকে সম্মিলিতভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আগামী দিনের নেতৃত্বদানকারী যুব সমাজ যাতে মরণ নেশা মাদকদ্রব্যে আসক্ত না হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ প্রশাসনসহ মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরকে অভিযান অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। সচেতন মহলের দাবী এখনই সময় মরণ নেশা মাদকদ্রব্যের ভয়াবহতার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশ প্রশাসনের কার্যকরী অভিযান চালানো। মাদকের এ ভয়াল গ্রাস ও এর ভয়াবহতা থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে না পারলে দেশ এক সময় মেধা শূন্যতায় পড়তে পারে বলে তারা মনে করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন