আরিফ মেহমুদ ॥ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থী অধ্যুষিত রক্তাক্ত জনপদ কুষ্টিয়ায় হঠাৎ করে জবাই করে খুনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবারো সেই আগের মত ঘুম ভাঙ্গলেই খুনের ঘটনার সংবাদ ভেসে আসছে কানে। মাত্র তিন মাসে আধিপত্য বিস্তার, সামাজিক বিরোধসহ নানা কারণে প্রতিপক্ষের গুলিতে ও দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে ও জবাই করে খুন হয়েছেন মহিলাসহ ২২ জনেরও বেশি মানুষ। আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক নারী, পুরুষ, ও শিশু। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ বেশ কয়েকজনকে আটক করতে পারলেও অধিকাংশ মামলারই চুড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে পারেনি। এলাকাবাসী ও নিহতদের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত মার্চ ২০১২ থেকে চলতি জুন মাস পর্যন্ত কুষ্টিয়ার সদর, কুমারখালী, দৌলতপুর, মিরপুর, ভেড়ামারা ও খোকসা উপজেলার সাতটি থানা এলাকায় মহিলাসহ ২২জনেরও বেশি ব্যক্তি খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে অপহরণের পর খুনের ঘটনাও রয়েছে একাধিক। তবে অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটেছে সামাজিক, মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ও পারিবারিক বিরোধের জের ধরে।
গত ১ জুন সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের বানিয়াপাড়ায় জমি সংক্রান্ত পারিবারিক বিরোধের জের ধরে মামাতো ভাইয়ের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন কলেজ ছাত্র তুহিন (২৬)। সে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের নতুন বোয়ালদাহ গ্রামের শহীদ মোল্লার ছেলে। গত ৯ জুন শনিবার দুপুরে কুষ্টিয়া শহরের ডিসি কোর্টের পাশে মাঠপাড়ার একটি বাসায় পূর্ব মজমপুরের মৃত সদর উদ্দিনের ছেলে ইব্রাহিম ওরফে কালুকে বটি ও চাকু দিয়ে জবাই করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ১১ জুন সোমবার দিবাগত রাতে সদর উপজেলার জোতপাড়া-শৈলগাড়ি মাঠে আবু বক্কর সিদ্দিক (৩২) নামের এক কৃষককে জবাই করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, গত রবিবার রাত দশটার দিকে জোতপাড়া দক্ষিনপাড়ার চায়ের দোকানে চা পান করার পর দু’জন লোক ওই এলাকার আব্দুল জলিলের ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিককে কৌশলে ডেকে নিয়ে যায়। রাতে অনেক খোঁজাখুজি করেও তার সন্ধান পায়নি পরিবারের স্বজনরা। গত সোমবার ভোরে স্থানীয় কৃষকরা মাঠে কাজ করতে গেলে জোতপাড়া গোরস্থান মাঠের নির্জন এলাকায় তার লাশ দেখতে পায়। পরে পুলিশকে সংবাদ দিলে পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। ২৮ মে রাতে জেলার খোকসা উপজেলা শহরে একটি পাট ক্রয়কেন্দ্রে ইছাহক আলী (৫৫) নামের এক শ্রমিককে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তিনি ফরিদপুরের বোয়ালিয়া থানার তেতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। খালিশপুর জুটমিলের কর্মচারী হিসেবে খোকসায় অবস্থানকালে তাকে হত্যা করা হয়। এদিকে গত ২২ মে কুষ্টিয়া কুমারখালীর পৃথক স্থানে মহিলাসহ দু’জন খুনের শিকার হন। ওইদিন সন্ধ্যায় উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের গবরা গ্রামে পূর্ব শত্র“তার জের ধরে নাজমা (৩৫) নামের এক মহিলা নিহত ও অন্তত ২০জন আহত হন। একই দিনে কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নের রায়ডাঙ্গা গ্রামের গড়াই নদীর চর থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৯ মে রাতে কুষ্টয়া শহরের গোসালা এলাকায় শাহিদা খাতুন (৪৫) নামের এক মহিলাকে গলায় ফাঁস দিয়ে ও মাথায় আঘাত করে খুন করে সন্ত্রাসীরা। ৮ মে রাতে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার উজানগ্রাম ইউনিয়নের দুর্বাচারা গ্রামের শেখপাড়ায় এক রিক্সা-ভ্যান চালককে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে খুন করে সন্ত্রাসীরা। ১মে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের খলিষাকুন্ডির পাঁচপীরতলা রাস্তার পাশ থেকে গুলিবিদ্ধ যুবক কারিবুলের (৪০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের পরিবারের দাবি তাকে অপহরণের পর পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ১৯ এপ্রিল কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলার মালিহাদ ইউনিয়নের ঝুটিয়াডাঙ্গা গ্রামের মাঠ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) আঞ্চলিক নেতা মোতালেব হোসেনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের চরমপন্থীরা তাকে হত্যা করতে পারে বলে পুলিশের আশংকা। ১৩ এপ্রিল তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া কুমারখালীর পান্টি গ্রামের দু’দলের সংঘর্ষে মঞ্জু নামের এক যুবক নিহত ও অন্তত ২০জন আহত হন। ২১মার্চ রাতে কুষ্টিয়ার মিরপুরের নওপাড়া মাঠে জামাল ডাকাতকে (৫২) গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন সকালে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৫ মার্চ রাতে কুষ্টিয়া শহরের আমলাপাড়াস্থ নিজ বাড়িতে স্কুল ছাত্র সানিম (১৬) সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। ১০ মার্চ কুষ্টিয়া শহরের ট্রিপল ভেনচার ডট কম লিমিটেড’র ব্রাঞ্চ অফিসের বাথরুম থেকে স্বপন (২৩) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়াও কুষ্টিয়া শহরে মহিলাসহ ভেড়ামারা ও মিরপুরে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কতিপয় সন্ত্রাসীকে পুলিশ আটক করতে পারলেও এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিশ। অন্যদিকে এ তিনমাসে জেলার বিভিন্ন এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে চার শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হন। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে স্বার্থজনিত বিরোধ। তবে কুষ্টিয়ার চরমপন্থীদের দৌরাত্ম আগের তুলনায় অনেক কমেছে বলে দাবি করেন তিনি। জেলার এসব সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদঘাটনের পাশাপাশি খুনিদের অধিকাংশ সদস্যকেই পুলিশ ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে। জেলার আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামীতে অপরাধীদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত থাকবে। অপরাধী সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন