আরিফ মেহমুদ ॥ কুষ্টিয়ায় মাল্টিপারপাসসহ বিভিন্ন সমবায় সমিতির অন্তরালে অবৈধ বেপরোয়া ব্যংকিং ব্যবসা চলছে জমজমাট। সমবায় ও জয়েন্ট স্টকের রেজিস্ট্রেশনকে পুঁজি করে অবাধে এই অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হলেও দেখার কেউ নেই। সরকারী বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে মোটা অংকের মুনাফার লোভ দেখিয়ে মূলধন সংগ্রহ ও সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মাল্টিপারপাসসহ বিভিন্ন সমবায় সমিতি ব্যাংকিংয়ের নামে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে বাংলাদেশে সমবায়ের অগ্রযাত্রা শুরু হলেও সমবায় সেক্টর নিয়ে প্রতিবছর কাগজে-কলমে অডিট ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে কোন তদারকি নেই। ফলে এ সেক্টরে চলছে অনেকটা অরাজক পরিস্থিতি। জেলার ৬ উপজেলায় বর্তমানে ২২৫৮টি মাল্টিপারপাস ও বিভিন্ন সমবায় সমিতির কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে সমবায় সমিতির ১০৬৯টি এবং বিআরডিবি’র ১১৮৯টি। এদের মধ্যে প্রায় ৫ শতাধিক মাল্টিপারপাস ও সমিতিই অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি মূলধন সংগ্রহ ও সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান দেখভালের জন্য প্রতিটি উপজেলা সদরে সমবায় অফিস দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জেলার ৬টি সমবায় অফিসে ২৪ জন পরিদর্শক কাজ করলেও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে সংশি¬ষ্ট সমবায় সমিতিকে শোকজ নোটিশ ছাড়া কোন সমিতির বিরুদ্ধে বড় ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। জেলা সমবায় অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ৬ উপজেলায় এক হাজার ৬৯টি মাল্টিপারপাস ও বিভিন্ন নামের সমবায় সমিতির নিবন্ধন দেয়া হলেও বর্তমানে এ জেলায় ৫০ ভাগ সমিতির কার্যক্রম রয়েছে। প্রায় ৩৪৩টি সমিতির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সূত্র জানায়, নিবন্ধন লাভের প্রতিবছরই অডিটের নামে বড় ধরনের অনিয়ম করে সমবায় সমিতিগুলো সব কিছু জায়েজ করে নিচ্ছে। জেলা ও উপজেলা সদরের সমিতিগুলো দেখভালের জন্য জেলা সদরের ১৪ জন সমবায় পরিদর্শককে নির্দিষ্ট উপজেলা ও সমিতি চিহ্নিত করে দেয়া হলেও কোন কাজ হচ্ছে না। উপজেলাওয়ারি নিবন্ধিত মাল্টিপারপাস ও বিভিন্ন ক্যাটাগরির সমবায় সমিতির সংখ্যা হচ্ছে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ২২৪টি, ভেড়ামারা উপজেলায় ১১৬টি, দৌলতপুর উপজেলায় ২৮৫টি, মিরপুর উপজেলায় ২৪১টি, কুমারখালী উপজেলায় ১৪১টি ও খোকসা উপজেলায় ৬২টি মোট ১ হাজার ৬৯টি মাল্টিপারপাস ও সমবায় সমিতির নিবন্ধন রয়েছে। এসব সমিতিতে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪৬৯ জন সদস্য বা উপকারভোগী সম্পৃক্ত রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, অধিকাংশ সমবায় সমিতিতে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ হারে সুদের ব্যবসা চালানো হচ্ছে। কারণ ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে মূল টাকা ও বার্ষিক লভ্যাংশ একত্রিত করে মাসিক কিস্তিতে ভাগ করে চক্র বৃদ্ধি হারে দ্বিতীয় মাস থেকে সুদ ও আসল টাকার কিস্তি আদায় করা হচ্ছে। কিছু কিছু সমিতি ইসলামী ও শরিয়া মোতাবেক ব্যবসা চালানোর নামে মাসিক লাখ প্রতি এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে। এছাড়া কিছু সমিতি বিভিন্ন লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ দেখিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে মাস শেষে সুদ প্রদান করলেও বছরান্তে বিনিয়োগকৃত প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের হিসাব না করেই সুদ জায়েজ করার কৌশল হিসেবে আমানতকারীকে প্রতারণার মাধ্যমে বছর শেষে মাসিক আরও ৪০০-৫০০ টাকা পরিশোধ করে। অবৈধ ব্যাংকিংয়ের নামে ডিপিএস ও মধ্য মেয়াদী ফিক্সড ডিপোজিট পদ্ধতি চালিয়ে একদিকে যেমন মাল্টিপারপাস ও সমবায় সমিতির কর্নধররা কোটিপতি বনে যাচ্ছে। অন্য দিকে এসব ব্যাংকিং চালুর ফলে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখনই এদের এসব অবৈধ ব্যাংকিংয়ের লাগাম টেনে না ধরলে এক সময় জনগণ মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হবে এর দায়-দায়িত্ব নেবে কে? এব্যাপারে কুষ্টিয়া জেলা সমবায় কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, সমবায় সমিতির নামে নিবন্ধন নিয়ে কোন সমিতি যদি অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়াও জেলা সমবায় অফিস থেকে ১৪ জন পরিদর্শক নিয়মিত সমবায় সমিতির কার্যক্রম তদারকি করে আসছে। কার্যক্রম কিংবা বার্ষিক অডিট রিপোর্টে কোন অনিয়ম পেলে সংশি¬ষ্ট সমবায় সমিতিকে শোকজ নোটিশ প্রদান করা হয়। মাল্টিপারপাস ও সমবায় সমিতির উপকারভোগি সদস্যরা আইন ও বিধি মোতাবেক তাদের মূলধন বৃদ্ধির জন্য আমানত গ্রহণ ও শেয়ার বিক্রি করতে পারবে। সদস্য ছাড়াও যে কেউ সমিতির কার্যক্রমের উপর আস্থা রেখে আমানত জমা রাখতে পারবে। তবে এদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বন্ধের আগে সুনিদৃষ্টভাবে জানতে হবে তারা সমিতির কার্যক্রমের সাথে কত টুকু ব্যাংকিং চালু রেখেছে। সুনিদৃষ্ট অভিযোগ পেলে নিবন্ধন বাতিল সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সমবায় সমিতির সঙ্গে সংশ্লি¬ষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস কিংবা সমবায় থেকে নিবন্ধন লাভের সময় সংঘ স্মারক ও গঠনতন্ত্র অনুমোদন লাভের জন্য নির্ধারিত হারে মাসোয়ারা দিলে তাতে সমবায় আইন বহির্ভূত ধারা-উপধারা যা-ই থাকুক না কেন কোন পরিবর্তন ছাড়াই সব কিছু অনুমোদন করে দেয়া হয়। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায় কুষ্টিয়ায় ব্যাংক পরিচালনা কিংবা সমিতির নামে আর্থিক লেন-দেনের কোন অনুমোতি দেয়া হয়নি। নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের এ ধরনের দুর্নীতির কারণেই কুষ্টিয়ায় সম্ভাবনাময় সমবায় সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও নিবন্ধন প্রদানের পর এসব সমবায় সমিতির তদারকি করার জন্য সমবায় অফিস, সমবায় অধিদফতর ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর কোন পদেক্ষপ না থাকায় সারা দেশের মতো কুষ্টিয়াতেও সমবায়ের কার্যক্রমে চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন