আরিফ মেহমুদ ॥ বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় ওএমএসের আটা দিয়ে চলছে চরম অরাজকতা। ন্যায্যে মুল্যে সাধারন মানুষের মাঝে আটা বিক্রির কথা থাকলেও বাসত্মবে তা হচ্ছে না। আটা বিক্রির নামে পকেট ফুলে কলা হচ্ছেন ফুড অফিসের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ডিলার ও মিল মালিকরা। ডিলার ও ফুড অফিসের কর্তারা অনিয়মের বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। অনুসন্ধানে ওএমএসের আটা বিক্রির নানা অনিয়ম দূর্ণীতির চিত্র পাওয়া গেছে। সাধারন মানুষের নামে বরাদ্দকৃত আটা প্রতিদিন চলে যাচ্ছে কালোবাজারে। ওএমএসের আটা বিক্রি চালু থাকায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে মিল মালিকরা। কুষ্টিয়া শহরে ওএমএসের আটা বিক্রির জন্য ১৭জন ডিলার রয়েছে। ১৭জন ডিলারকে প্রতি সপ্তাহে ৭০০ কেজি আটা সরবরাহ করা হয়। একই ভাবে কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুর-ঝিনাইদহ ও রাজবাড়ি জেলাতেও ওএমএসের আটা সরবরাহ করছে মিলাররা। জেলা ফুড অফিস জানিয়েছে, ৫জন মিলার কুষ্টিয়াসহ আশেপাশের কয়েকটি জেলায় আটা সরবরাহ করছে। এরমধ্যে রয়েছে চিত্ত রঞ্জন পালের মালিকানাধীন মিনকো ফ্লাওয়ার ১, ২, সাবিবর গাফ্ফারের মালিকানাধীন কুষ্টিয়া ফ্লাওয়ার মিল, মিজানুর রহমানের মালিকানাধীন গড়াই ফ্লাওয়ার মিল, খোকসায় আব্দুল মজিদের মালিকানাধীন খোকসা ফ্লাওয়ার মিল ও হাজী আশরাফের মালিকানাধীন আশরাফ ফ্লাওয়ার মিল। খাদ্য অফিসের কর্মকর্তারা জানান. প্রতিমাসে মিলের উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী গম বরাদ্দ পান মিল মালিকরা। আড়াইশ টন থেকে শুরু করে ৭০টন পর্যমত্ম বরাদ্দ পান মালিকরা। গম গোডাউন থেকে নেয়া থেকে শুরু করে আটায় রূপামত্মর করা পর্যমত্ম সকল খরচ মিল মালিকদের। সরকারের সাথে শর্ত অনুযায়ী মিল মালিকরা ১০০টন গম থেকে আটা তৈরি করে সরবরাহ করেন ৭৭টন। বাকি ২৩টন আটা তারা রেখে দেন। তাদের ব্যায় মেটাতে বিপুল পরিমান আটা তারা রেখে দিচ্ছেন। যার মুল্যে ৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা। তবে এ টাকার অর্ধেক তাদের খরচ হয়না। গড়াই ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মিজানুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, গোডাউন থেকে গম এনে আটা তৈরি করে পৌঁছে দেয়া পর্যমত্ম তাদের কাজ। গম আনার পর প্রসেস করার সময় কিছু ঘাটতি হয়। তবে কি পরিমান খরচ হয় সে হিসাব তাদের নিকট নেই। তবে খুব বেশি লাভ থাকে না বলে দাবী করেন তিনি। এদিকে প্রতিদিন বিকেল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৯টা পর্যমত্ম নিদিষ্ট ১৭টি পয়েন্টে আটা বিক্রির কথা । অথচ দু’একটি পয়েন্ট ছাড়া সারাদিনেও কোন ডিলার তাদের দোকান খোলেন না। গত সোমবার দুপুর ১২টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের কোর্ট ষ্টেশন রোডের জোনাকি বীজ ভান্ডার নামের একটি ওএমএস পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে দোকানের ঝাপ বন্ধ। ডিলারসহ তার কোন লোকজন নেই। ষ্টেশন রোডের ডিলার আজমল হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আটা শেষ তাই দোকান বন্ধ। একই দিন শহরের আমলাপাড়ায় এক ফুড কর্মকর্তার আত্মীয় ডিলার কাজি নজরুল ইসলাম, লাহিনী বটতলায় শাহাদৎ হোসেন, মিলবাজার এলাকায় আনোয়ার হোসেন, হাউজিং এলাকায় শেখ টিপু সুলতান ও শহরের ৬ রাসত্মার মোড়ের ডিলার পিন্টু খন্দকারের দোকানে গিয়ে আটা বিক্রির দৃশ্য চোখে পড়েনি। সকালের দিকে দু’একটি দোকান খুললেও ঘন্টা খানেকের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় বলে এলাকার লোকজন জানান। ৬ রাসত্মার মোড়ে বাড়ি ভ্যান চালক রেজাউল জানান, মাঝে মধ্যে আটা পাওয়া যায়। দুপুরের পর পয়েন্ট আর খোলা থাকে না। পৌর বাজারের ওএমএস ডিলার আকবর আলী জানান, গম ও আটার বাজার দর এখন কম। তাই সাধারন লোকজন পয়েন্ট থেকে আটা কম নেয়। তাই তাদের বিক্রিও কম। তিনি বলেন, অন্য কোথাও অনিয়ম হতে পাওে, তবে তার এখানে কোন অনিয়ম হয় না। রাত্রি বেলা আসলেও লোকে আটা পায় বলে দাবী করেন তিনি। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক খাদ্য ব্যবসায়ী জানান, প্রতিটি ডিলারকে এক সপ্তাহে ৭০০কেজি আটা নেয়া বাধ্যতামূলক। ১৯ টাকা কিনে তারা ২০ টাকায় বিক্রি করেন। তবে বাজার পড়ে যাওয়ায় সারাদিন দোকান খুলে রেখে শ্রমিক দিয়ে আটা বিক্রি করে ডিলাররা তেমন লাভ পান না। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন আটা তোলেন ডিলররা। ৫০ কেজির ৪২ বসত্মা আটা মিলারদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও তারা তা নিচ্ছেন না। ১০ থেকে ১৫ বসত্মা পর্যমত্ম তুলছেন ডিলাররা। খাদ্য পরিদর্শকরা প্রতিদিন ১০০ টাকা ঘুষ নেন প্রতিটি পয়েন্ট থেকে। তাই সারা দিন কি হচ্ছে সেটি তারা দেখেন না। অন্য একটি সুত্র জানায় ডিলাররা অতিরিক্ত ২০০ টাকা লাভে মিলারদের নিকট ওএমএসের আটা বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ থেকে প্রতি ডিলার মাসে অতিরিক্ত ১২ হাজার টাকা আয় করছেন। আর আটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারন মানুষ। মিল মালিকরা ডিলারদের নিকট থেকে আটা নিয়ে প্যাকেট করে তা চড়া দামে বাজারে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে প্রতি মাসে বিপুল পরিমান আটা মিল মালিকরা ডিলারদের নিকট থেকে অল্প মুল্যে কিনে নিচ্ছেন। খাদ্য পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুল ওয়াহেসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা এ অনিয়মের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিটি পয়েন্ট তদারকির জন্য খাদ্য পরিদর্শক আছেন। একজন কর্মকর্তাকে ৩টির অধিক পয়েন্টও দেখতে হয়। কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য অফিসের সহকারি খাদ্য পরিদর্শক ইকবাল হোসেন জানান, প্রতিদিন তাকে ৩টি পয়েন্ট দেখতে হয়। দু’টি পয়েন্টে গেলেও অন্য পয়েন্টে যাওয়ার সময় পান না। অনেক ডিলার ঠিক মত আটা বিক্রি করতে চান না বলে তিনি জানান। এ আটা যায় কোথায় সে প্রশ্ন তারও। ডিলারদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। ডিলাররা ঠিক মত আটা বিক্রি করছে কি-না তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি মনিটরিং টিম আছে। সে টিমে জেলা প্রশাসন, ইউএনও ও ফুড কর্মকর্তারা যুক্ত আছেন। তবে তারা এক দিনও পরিদর্শনে যান না। ওএমএসের আটা নিয়ে নয় ছয়ের জন্য ফুড কর্মকর্তারা দায়ী বলে সাধারন লোকজন অভিযোগ করেছেন। প্রতি মাসে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও খাদ্য পরিদর্শকরা মিল মালিক ও ডিলারদের নিকট থেকে মাসোহারা নিচ্ছেন। তাই আটা কোথায় যায় সেটি তারা দেখেন না। কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুজা আলমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ওএমএসের আটা নিয়ে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে। তার অফিসের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন