শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১২

প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতার কাছে জিম্মি, লালন একাডেমীঃ উপেক্ষিত প্রবীণ বাউলরা

এ.এইচ.এম.আরিফ,কুষ্টিয়া ॥ কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের গুটিকয়েক নেতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে কুষ্টিয়ার লালন একাডেমী ও প্রবীণ বাউল সাধুরা। এ কারণে বাউলদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভাজন। এক বছর ধরে নির্বাচন না হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে একাডেমীর কার্যক্রম। জেলা প্রশাসন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে অথচ নিয়ন্ত্রণ করার কথা বাউলদের। বিগত বছরগুলোয় যেসব রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল, ঘুরে ফিরে তারাই আবার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। ১২২তম লালন স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান নিয়েও নানা অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন বাউলরা। লালন আখড়ার পাশের একটি বাড়িতে সাধুসংঘ করছেন বাউল বলাই সাঁই। তাকে ঘিরে রয়েছেন শিষ্য-ভক্তরা। ক্ষণে ক্ষণেই বেজে উঠছিল লালনের ভাবধারী গানের সুর। ছোট্ট জায়গায় অসংখ্য ভক্ত তার গান শুনছেন। তার মতো বহু জনপ্রিয় প্রবীণ বাউল শিল্পী আছেন, মনেপ্রাণে লালন চর্চা করেন। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলতের মোহে নয়, সাঁইজির প্রেমে মগ্ন তারা। অথচ লালনের মূল অনুষ্ঠানে উপেক্ষিত তারা। তাই তারা নিজেদের মতো করে লালন স্মরণোৎসব করছেন। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া মরা কালী নদীর পাড়ে ফকির লালন সাঁইয়ের সমাধি। সাঁইজির সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় লালন আখড়ায় প্রতি বছর লাখো শিষ্য-ভক্ত ছুটে আসেন। যুগ যুগ বছর ধরে বাউল-ফকিরদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে ফকির লালনকে পুঁজি করে স্থানীয় বিএনপি-আওয়ামী লীগের অনেক নেতার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। অনেকেই বনে গেছেন গাড়ি-বাড়ির মালিক। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হোসেন অভিযোগ করেন, লালনধাম ক্রমশ দুর্নীতিবাজরা দখল করে নিয়েছে। দুই হাতে একাডেমীর টাকা আত্মসাৎ করছে। বিএনপি সরকারের আমলে কুষ্টিয়ার বিএনপি দলীয় এক এমপি ও তার অনুগতদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এখানে। পাঁচ বছরে দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ওই সময়ের বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাডেমীর নির্বাচনে জয়লাভ করে শহর আওয়ামী লীগের নেতা তাইজাল আলী খানের প্যানেল। এরপর লালনের আখড়াবাড়ির পুরোটা করায়ত্ব করে নেন তিনি। তিন বছরে কোটি টাকার বেশি আয় হলেও লালন একাডেমী পরিচালনা কমিটির কাছে কোনো হিসাব দেননি তিনি। অনুষ্ঠান, মেলা, মাছ ধরা, নতুন সদস্য সৃষ্টিসহ আরও কয়েকটি খাত থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে নিজের প্যানেল সদস্যদেরই তোপের মুখে পড়েন ওই নেতা। তার মেয়াদকালে কোনো সাধারণ সভা পর্যন্ত হয়নি। বড় অঙ্কের টাকা দুর্নীতির বিষয়টি মাথায় নিয়ে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় তাকে সরে যেতে হয়। এ অবস্থায় একাডেমীর হাল ধরেন কুষ্টিয়ার বর্তমান জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক। নির্বাচন না দিয়ে জেলা প্রশাসক একটি আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে লালন একাডেমী পরিচালনা করছেন। একাডেমীর পুরো নিয়ন্ত্রণ জেলা প্রশাসকের হাতে। লালন একাডেমীর সাবেক কমিটির কয়েক সদস্য জানান, দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন সব সদস্য। জেলা প্রশাসক উদ্যোগ না নেওয়ায় নির্বাচন হচ্ছে না। ওই সদস্যরা জানান, তাইজাল আলী খান দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজারের বেশি নতুন ভোটার তৈরি করেছেন। আগে যেখানে ভোটার ছিল মাত্র দুই হাজার। জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক দায়িত্ব নেওয়ার পর তাইজাল আলী খানের দুর্নীতি তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি বিপুল অঙ্কের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ পান। দুর্নীতির বিষয়টি ধরা পড়ার পর তাইজাল আলী খান জেলা আওয়ামী লীগের কয়েক প্রভাবশালী নেতাকে দিয়ে তদ্বির শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের ফান্ডে প্রায় ৩ লাখ টাকা জমা দিয়ে পার পেয়ে যান তিনি। তাইজাল আলী খানসহ অনেক বিতর্কিত লোক এখনও জেলা প্রশাসনের কমিটিতে রয়েছে। গত এক বছরে নির্বাচিত কোনো কমিটি না থাকায় সবার মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। লালন একাডেমীর বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক মঞ্জু বলেন, একাডেমীতে আগে অনেকে দুর্নীতি করেছেন। তবে জেলা প্রশাসক ভালো চালাচ্ছেন। তারপরও এ মুহূর্তে সবার দাবি, দ্রুত একটি নির্বাচন। ১৬ অক্টোবর শুরু হওয়া পাঁচদিনের লালন স্মরণোৎসবেও নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে পাঁচদিনের আলোচনা সভায় কুখ্যাত রাজাকারপুত্র থেকে শুরু করে অনেক বিতর্কিত ও অযোগ্য লোককে অতিথি করা, সঙ্গীত অনুষ্ঠানে আত্মীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একাধিক বাউল জানান, স্থানীয় সরকার আমলাদের স্ত্রী-কন্যারা শিল্পী হিসেবে অনেক গুরুত্ব পেয়েছেন। অথচ মূল শিক্ষার্থীরা উপেক্ষিত। প্রবীণ বাউলরা অনেকেই ঠিকমতো সেবাও (খাবার) পাচ্ছেন না। মেহেরপুরের বাউল সাধক রহিম জানান, যেখানে লালন চর্চা হওয়ার কথা, তা না হয়ে এখন সেখানে হচ্ছে ব্যবসা। লালনকে নিয়ে নিত্যনতুন ব্যবসার ফন্দি আঁটা হচ্ছে। ফলে বাউলদের মধ্যে বিভাজনও সৃষ্টি হচ্ছে। স্মরণোৎসবের মূল আয়োজনে কুষ্টিয়ার অনেক প্রবীণ বাউল ও লালন-গবেষক দাওয়াত পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্মরণোৎসবে ১০টি উপ-কমিটি করা হয়েছে। অথচ এ কমিটিতে বাউলদের কর্তৃত্ব নেই। লালন স্মরণোৎসবের চতুর্থ দিন আজ শুক্রবার ছুুটির দিনে উৎসবের মাত্রা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে আয়োজকদের আশা। উৎসবের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে বাংলালিংক। উৎসব শেষ হচ্ছে আগামীকাল শনিবার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন