রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১২

কাল শুরু হচ্ছে ৫ দিনব্যাপী বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের ১২২তম মৃত্যুবার্ষিকী

আরিফ মেহমুদ ॥ মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই বাঙালির চেতনায় এক অবিস্মরণীয় কালপুরুষ। তাঁর গানের মাঝেই লুকিয়ে আছে সুষ্টির রহস্য। সৃষ্টিকর্তার সাথে আত্মিক সম্পর্ক তাঁর গানের মূলমন্ত্র। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে একই স্রোতধারায় আনার জন্য লালন সঙ্গীত আজও আমাদের অনুপ্রানিত করে। এই মহান সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাইয়ের ১২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ীতে কাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে ৫ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। দেশের বৃহত মোবাইল ফোন কোম্পানী বাংলা লিংকের পন্সারে, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় ও কুষ্টিয়া লালন একাডেমির আয়োজনে এবারের ভিন্ন আমেজের মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে ইতোমধ্যেই আখড়া বাড়ীতে সকল প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে। সত্য সু-পথের সন্ধ্যানে মানবতার দিক্ষা নিতে আত্মার টানে দেশ-বিদেশের সাধুগুরু ও ভক্তরা দলে দলে  আসতে শুরু করেছে সাঁইজির মাজারে। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী প্রতিবার দু’ অথবা তিনদিনের এ উৎসব পালিত হলেও গতবারের স্মরণোৎসব থেকে তা বাড়িয়ে পাঁচদিনের প্রথা চালু করা হয়েছে। এবারো তার ভিন্নতা নেই। বাউল সম্রাটের ১২২ তম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা সাজানো হয়েছে ৫ দিনব্যাপী। মূল উৎসব শুরু হওয়ার ৭-৮ দিন আগ থেকে আখড়ায় আসা বাউল সাধকরা মাজারের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে গেয়ে চলেছে সাইজির আধ্যাত্মিক মর্মবাণী ও ভেদ তথ্যের গান। জমজমাট এখন লালন শাহের আখড়া বাড়ি। কুষ্টিয়া পরিণত হয়েছে উৎসবের শহরে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় ও লালন একাডেমীর আয়োজনে কাল ১৬ অক্টোবর (১কার্তিক) থেকে শুরু হয়ে একটানা ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ৫ দিনব্যাপী বাউল সম্রাট সাধক ফকির লালন সাইয়ের ১২২ তম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান চলবে। আখড়া বাড়ীতে মঞ্চ, গ্রামীণ মেলার স্টল নির্মাণ ও মাজার ধোয়া মোছার কাজ শেষ করা হয়েছে। কালী নদী তীরবর্তী লালন মঞ্চের সামনে আয়োজন করা হয়েছে গ্রামীণ মেলার। বিভিন্ন স্টলের পাশাপাশি থাকছে শিশু বিনোদনেরও ব্যবস্থা। এবারের অনুষ্ঠানে আগত বাউল সাধূদের গোসলের সুব্যবস্থা করতে কুষ্টিয়া জেলার সুযোগ্য জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক কালী নদীতে একটি সুন্দর ঘাট ও অনুষ্ঠানে বাড়তী আকর্ষণ যোগাতে বাউল সম্রাট মরমী সাধক ফকির লালন শাহের বিশাল আকৃতির মুরাল ও মুর্তি নির্মাণ করেছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় উন্মুক্ত মঞ্চে বিশিষ্টজনদের মুক্ত আলোচনা শেষে গভীর রাত অবধি চলবে খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিবেশনায় লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান। সুষ্ঠুভাবে আয়োজন সম্পন্ন করতে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশের পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে থাকবে র‌্যাব ও সাদা পোষাকে গোয়েন্দা পুলিশ। মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আসা দেশ-বিদেশের লাখ ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরুদের চরণ ধূলায় সিক্ত হবে বাউল সম্রাটের ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ী। সাঁইজির মতাদর্শের ধর্ম আর জাতি ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কল্যাণে মানুষ নিবেদিত থাক চিরকাল এবং মানবতার নিগুড় প্রেমের ভাবধারা বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ভক্তকুলের এই অঙ্গীকার। সভ্যতার এই যুগে মানুষ মানুষে হিংসা বিদ্বেশ ভূলে সাঁইজির ধর্মদর্শনের চিরাচরিত ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’ও মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি এই শ্লোগানকে বাস্তবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে হবে। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল জলিলের সভাপতিত্বে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়া-৪ (খোকসা-কুমারখালী) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য বেগম সুলতানা তরুন, কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, কুমারখালী উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ, খোকসা উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সদর উদ্দিন খান, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম, কুষ্টিয়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র মতিয়ার রহমান মজনু, লালন একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাইজাল আলী খান, কুষ্টিয়া শিশু হাসপাতালের সাধারণ সম্পাদক আক্কাস আলী মঞ্জু। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন বাংলালিংক খুলনা’র রিজিওনাল কমার্শিয়াল হেড বাবুল হক। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন কুমারখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান। উল্লেখ্য, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে, মানুষ গুরুর দিক্ষা দিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র আবির্ভাব ঘটে কুমারখালির ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজো অজানায় রয়ে গেছে তাঁর জন্ম রহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আর্থিক অসংগতির কারনে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। যৌবনকালে পূর্ণ লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমনে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপান্তর ও সাধন জীবনে প্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহ’র আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি সাধক ফকিরী লাভ করেন। প্রথমে তিনি কুমারখালির ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের একটি আমগাছের নীচে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন। লালন ভক্ত মলম শাহ আখড়া তৈরীর জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতে ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে। প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরী করা হয়। সেই ঘরেই তাঁর সাধন-ভজন বসতো। ছেঁউড়িয়ার আঁখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিষ্যভক্তদের নিয়ে পরিবৃত থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক বাউল সম্রাট দেহত্যাগ করেন এবং তাঁর সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়। আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে লালন মঞ্চে বিভিন্ন শিল্পি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হবে লালন সঙ্গীত। এতে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন দেশের খ্যাতনামা শিল্পীবৃন্দসহ লালন একাডেমীর স্থানীয় শিল্পিরা। উৎসবকে ঘিরে পুরো একাডেমি চত্ত্বরে শুরু হয়েছে খন্ড-খন্ড স্থানে গান পরিবেশন। এসব গান শুনে আগত দর্শক-শ্রোতারাও নেচে-গেয়ে গানের সাথে সাথে তাল মিলাচ্ছে। মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠানটি সার্বিক উপস্থাপনা ও পরিচালনা করবেন কবি শুকদেব সাহা ও সুমাইয়া খানম ইভা।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন