শনিবার, ২৮ জুলাই, ২০১২

গড়াই নদীতে ডুবে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ২ ছাত্রের করুণ মৃত্যু

আরিফ মেহমুদ ॥ চিসিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করার সাধ অপূরণই থেকে গেল মেধাবী ছাত্র মিলন ও রিফাতের । স্বপ্ন পুরুণ হলো না তাদের। তার আগেই গড়াই নদী কেড়ে নিল তাদের সব স্বপ্ন। বন্ধুদের সাথে গোসল করতে গিয়ে গড়াই নদীতে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ১ম বর্ষের এ দুই মেধাবী শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। রিফাতের বাড়ি কুমিল্লা ও মিলনের বাড়ি দিনাজপুর জেলায়। সন্ধ্যার পর ডুবুরিরা দুই ছাত্রের লাশ গড়াই নদী থেকে উদ্ধার করে। পানিতে ডুবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে তিন ছাত্রী। এ সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয় গড়াই নদীপাড়ে। গতকাল শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে গড়াই নদীর রেণউইক ঘাট এলাকায় মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটেছে। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী মিলনের বন্ধু বাঁধন ও উজ্জল জানান, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ৫ বান্ধবীকে নিয়ে তারা ৫ বন্ধু গড়াই নদীর রেণউইক ঘাট এলাকায় গোসল করতে যান। ঘাটে যাওয়ার পর প্রথমে তাদের ৫ বান্ধবী নুসরাত আলভী, শারমিন কাকলী, মনামী, বুশরা ও মাসুমা পানিতে নামে। এরপর পরই মিলন ও রিফাত, অমল বোসসহ তারা ৫ বন্ধু পানিতে নামেন। কোমর পানিতে নামার পরই তাদের সবার পা’র নিচ থেকে মাটি সরে যায়। এ সময় সবাই চিৎকার শুরু করে। পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকে সব বন্ধুরা। সাঁতার জানা রিফাত ও উজ্জল সাঁতরে উপরে উঠে আসে এবং তাদের তিন বান্ধবীকে টেনে তীরে নিয়ে আসে। এ সময় ফরিদুল হাসান মিলন ও শাহজালাল মজুমদার রিফাত ছাড়া সবাই উপরে উঠে আসতে সক্ষম হয়। গুরুতর অসুস্থ তিন শিক্ষার্থীকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসীন আহত নুসরাত, শারমিন ও মনামী জানান, পানিতে নেমে কিছুদূর যাওয়ার পর তারা বড় গর্তে পড়ে যায়। এ সময় সবাই ভয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে। তাদের বান্ধবীদের কেউ সাঁতার জানে না। অন্য বন্ধুরা তাদের উপরে টেনে তোলে। গর্তে পড়ে যাওয়ার পর পানির গভীরে তলিয়ে যায় মিলন ও রিফাত। সংবাদ পেয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা নদীর ঘাটে ভীড় করে। এ সময় এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিলন ও রিফাতের সহপাঠিরা। নদীর ঘাটে আসেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আলহাজ্ব ফজলুর রহমান, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ ইফতেখার মাহমুদ, পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ জামাল হোসেন মোল¬া, ডাঃ নওয়াব আলী ও স্বাচিপ নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডাঃ আমিনুল হক রতন। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন বলেন, নিখোজ দু’ছাত্র উদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যার ফলে সন্ধ্যার আগেই লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের অফিস সহকারি সেলিম হোসেন জানান, ঘটনার পর থেকে একাধিক ট্রলারে করে স্থানীয় মাঝি ও জেলেরা মিলন ও রিফাতের খোঁজে নদীতে নামে।  স্থানীয় বাসিন্দা আতিয়ার জানান, শিক্ষার্থীদের চিৎকার শুনে তিনি এগিয়ে আসেন। এসে দেখেন কয়েকজন উপরে উঠে এসেছে। তিনি বলেন, যেখানে তারা গোসলে নেমেছে সেই স্থানে গভীর গর্ত রয়েছে। যার কারনে তারা পা ফঁসকে নিচে পড়ে যায়। খবর পেয়ে এলাকার লোকজন নদীর ঘাটে ভীড় জমায়। অধ্যক্ষ ডাঃ ইফতেখার মাহমুদ জানান, দুই ছাত্রের লাশ রাতে উদ্ধার করা হয়েছে। খুলনা থেকে ফায়ার ব্রিগেডের দুই ডুবুরি এসে বিকেল ৬টার দিকে গড়াই নদীতে নেমে নিখোঁজ রিফাত ও মিলনকে উদ্ধারে অভিযান শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রেনউইক বাঁধের পূর্ব অংশ থেকে প্রথমে রিফাতের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। প্রায় ৩০ ফুট গভীরে তার লাশ পাওয়া যায়। এর ১৫ মিনিট পর ডুবুরিরা উদ্ধার করে মিলনের মৃতদেহ। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স এসে রিফাত ও মিলনের মৃতদেহ পোষ্টমোর্টেম ঘরে নিয়ে যায়। মৃতদেহ দুটি নদী থেকে তোলার পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রিফাত ও মিলনের বন্ধুরা। এ সময় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি কেউ। মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ ইফতেখার মাহমুদ জানান, আগামীকাল শনিবার ময়না তদন্ত শেষে মিলন ও রিফাতের লাশ নিজ নিজ জেলায় পাঠিয়ে দেয়া হবে।তিনি জানান সকলেই অত্যান্ত মেধাবী এবং ভাল মনের মানুষ। তাদের সাথে অল্প দিন মিশতে পেরে আমরা পরস্পর আপন হয়ে গেছি। তাদের অকাল মুত্যুতে সকলে মুষড়ে পড়েছে। গতকাল উভয়ের বাড়িতে মোবাইলে তাদের মুত্যুর খবর জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ফরিদুল হাসান মিলন (২২) দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক আব্দুল খালেকের একমাত্র পুত্র এবং রিফাত মজুমদার (২৩) কুমিল্লা শহরের ফৌজদার মোড়ের সরকারী চাকুরীজীবি শাজাহান মজুমদারের একমাত্র পুত্র। ঘটনার পর কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখা যায় সেখানে সুনশান নিরবতা। সবাই নদীর ঘাটে গেছে দুই বন্ধুর খোঁজে। গোসল করতে গিয়ে বেঁচে আসা দুই শিক্ষার্থী বাঁধন উজ্বল ঘুমিয়ে আছে একটি রুমে। তারা ঠিক মত কথা বলতে পারছে না। এদিকে, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে ছাত্র-ছাত্রীসহ শিক্ষকদের ইফতার মাহফিলের আয়োজন ছিল। এ ঘটনার পর সেটি স্থগিত করা হয়। মেডিকেলের সকলের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রেনউইক বাঁধ এলাকায় নিখোঁজ ছাত্রদের সহপাঠীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায়। গত বছরের ৭ জানুয়ারি ৩২জন ছাত্রী ও ২০ জন ছাত্র নিয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন