এ.এইচ.এম.আরিফ ঃ আজ ৫ সেপ্টেম্বর,কুষ্টিয়ার বংশীতলা দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীরত্বে গাঁথা এক ইতিহাসের দিন আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার বংশীতলায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। জীবনের মায়া ত্যাগ করে মা মাটি ও দেশের মানুষকে সেদিন মুক্ত করতে কুষ্টিয়ার দামাল ছেলে লড়েছিল চির শুত্র“ পাকবাহিনীর সাথে। কয়েক ঘন্টা ধরে চলে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আত্রমনের মুখে পাকহানাদাররা তাদের বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়েও অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হয়। বংশীতলার এ যুদ্ধে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। স্বাধীনতার ৩৬ বছর অতিবাহিত হলেও ৮ শহীদ পরিবারের খোঁজ রাখেনি কেউ। নাম মাত্র ভাতা আর বিজয় দিবসে কিছু উপঢোকন ছাড়া কিছুই পায়নি তারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মাচ ভাষণের পর ৬ দফা ও ১১ দফা দাবী আদায়ের সংগ্রামকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে সারা দেশের ন্যায় বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলাও সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে প্রতিবাদ সভা, মিছিল, অসহযোগ আন্দোলন, প্রতিরোধ যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গাতে অস্থায়ী রাজধানী এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় (মুজিবনগরে) অস্থায়ী রাজধানী থাকায় এ জেলা প্রতিরোধ যুদ্ধে ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ২৫ মার্চ রাতে ২৫০ জন পাক সৈন্য আকষ্মিকভাবে কুষ্টিয়ায় প্রবেশ করে। তারা শহরে প্রবেশ করেই কারফিউ জারী, ধর পাকড়, অত্যাচার, নির্যাতন ও যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ শুরু করে। এ সংবাদ সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক নেতা, কর্মী জনসাধারণ সবার মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। প্রতিকার ও প্রতিরোধের আগুন জ্বলে ওঠে সবার মধ্যে। এ কারনে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ফলে ১ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিণ নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ করে। এ দলের বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন কুষ্টিয়া সদর থানার দামাল ছেলেরা। কুষ্টিয়া শহরের আশপাশ ছিল এদের গন্তব্যস্থল। ১ সেপ্টেম্বর বিকেলের দিকে কুষ্টিয়া সদর থানার বৃত্তিপাড়া হতে পাক সৈন্য ও মিলিশিয়া পুলিশ বাহিনীর একটি দল দহকুলা গ্রামের মধ্যে দিয়ে আলামপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলার জন্য আসে। পরদিন অনেক পাক সৈন্য ও মিলিশিয়া পুলিশ আলামপুর গ্রামে আসে। তারা এ গ্রামের অনেক বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেয় এবং আলামপুর গ্রামে আসে। পাকবাহিনী এ গ্রামের অনেক বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেয় এবং আলামপুর গ্রামের কয়েকজন সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই ৫ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া সদর থানার বংশীতলা ও দূর্বাচারা গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা পাক সৈন্যের হামলা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে খুব সকালে প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন স্থানে সুবিধামত জায়গায় অবস্থান নিয়ে পাক সৈন্যের জন্য অপো করতে থাকেন। কিন্ত সকাল ১০ টা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা কোন পাক সৈন্যে দেখতে না পেয়ে তারা মনে করেন আজ আর পাক সৈন্য আসবে না। তাই তখন মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই যে যার মত নাস্তা খেতে যান এবং কেউ কেউ এদিক সেদিক ঘোরাফেরার মধ্যে ছিলেন। আর এ দলের মুক্তিযোদ্ধা ও লাইট মেশিন গানম্যান আব্দুল কুদ্দুস, আব্দুল কুদ্দুস তার সহকারী সেকম আলীকে নিয়ে বংশীতলা গ্রামের চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে আমগাছের গুড়ির পাশে অবস্থান নেয়। এমন সময় তারা দেখতে পান যে পাক সৈন্যরা পায়ে হেটে দূর্বাচারার দিকে আসছে। পাক সেনারা যখন আব্দুল কুদ্দুসের খুব কাছাকাছি চলে আসে তখন আব্দুল কুদ্দুস লাইট মেশিন গান দিয়ে তাদের উপর বিরামহীনভাবে ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করে। হটাৎ করে খুব কাছ থেকে পাক সৈন্যের উপর লাইট মেশিন গানের ব্রাশ ফায়ার শুরু হওয়ায় তারা তাৎণিকভাবে পাল্টা আক্রমনের সুযোগ পায়নি। রাস্তার দু‘ধারে অথৈ পানি থাকায় অবস্থান নিতে ও পালাতে পারেনি। আব্দুল কুদ্দুসের ব্রাশ ফায়ারেই ঘটনাস্থলেই অনেক পাক সৈন্য আহত ও নিহত হয়। বিরামহীনভাবে গুলিবর্ষণের ফলে লাইট মেশিন গানের ব্যারেল গরম হয়ে ফায়ার বন্ধ হয়ে যায় এবং এ সময়ে পাক সৈন্যের একটি গুলি এসে আব্দুল কুদ্দুসের পায়ে লাগে। এ ফাঁকেই পাক সৈন্যরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবস্থা বুঝে আব্দুল কুদ্দুছ ও সেকেমআলী পাক সৈন্যের নাগালের বাইরে চলে যায়। এ সময় দূর্বাচারা গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা গোলাগুলির শব্দ শুনে অগ্রসর হয়ে বংশীতলা গ্রামের কাছে চলে যায়। পাক সৈন্যরা বংশীতলা গ্রাম হতে দূর্বাচারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হবার প্রাক্কালে মুক্তিযোদ্ধা ও পাক সৈন্যের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এখানেও বেশ কিছু পাক সৈন্য আহত ও নিহত হয়। পাকিস্তান বাহিনী পিছন থেকে তাদের আর্টিলারি গ্র“প ২” ও ৩ ” মর্টার এবং রকেট ল্যান্সারের গোলা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নিপে করতে শুরু করে এবং বংশীতলায় হতে অনুমান ৩ মাইল দুরে কুষ্টিয়া টেক্সটাইল মিলে স্থাপিত পাক সৈন্যের ক্যাম্প হতেও যুদ্ধেেত্রর দিকে লহীনভাবে হেভি গানের গোলা নিপে করতে থাকে। এ সময় দূর্বাচারার মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পাক সৈন্যের অফিসার ক্যাপ্টেন জামিলকে হত্যা করেন। তাজুল ইসলাম এখান থেকে তার দলের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ফেরার সময় অন্য গোলার মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাক সৈন্যও চলে যায়। কয়েক ঘন্টা ধরে যুদ্ধ হয়। বংশীতলার যুদ্ধে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা কম-বেশি আহত হন এবং ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাক সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন। এ ৫ জনের মধ্যে ৩ জনের বাড়ী ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার। বাকী ২ জনের বাড়ী হরিণাকুন্ড থানায়। বংশীতলার যুদ্ধে পাক সৈন্যের সঙ্গে ১২ জন রাজাকার এসেছিল। তার মধ্যে ৬ জন যুদ্ধ ত্রে হতে পালিয়ে যায়। বাকী ৬ জন রাজাকার পাক সৈন্যের সঙ্গে ক্যাম্পে ফিরে যায়। পাকিস্তান বাহিনী সৈন্যবাহিনী বংশীতলা যুদ্ধে অপ্রত্যাশিতভাবে চরম ভাবে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজারেরও বেশি। বংশীতলার যুদ্ধের ৮ জন শহীদ হলেন- তাজুল ইসলাম,পিতা আব্দুল করিম সেখ, গ্রাম দূর্বাচারা, খোরশেদ আলম দীল, পিতা-শাদ আহম্মদ, গ্রাম গোপালপুর, সেখ দিদার আলী, পিতা, নুরুল ইসলাম, সাং- আড়–য়াপাড়া, ইয়াকুব আলী, পিতা কুদরত আলী, সাং কালীশংকরপুর, গোলাম মোস্তফা রাজ্জাক, পিতা মোহাম্মদ আলী, সাং আড়–য়াপাড়া, আবু দাউদ, পিতা ইয়াদ আলী মুন্সী, সাং দেশওয়ালীপাড়া, চান্দআলী মোলা, গ্রাম বংশীতলা, আব্দুল মান্নান, পিতা মোজাহার মোল্লা ,গ্রাম-বানিয়া খোড়ী। এখানে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা গরুতর আহত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে দূর্বাচারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে শহীদ ৮ মুক্তিযোদ্ধাকে দাফন করা হয়। এখনও তাদের কবর রয়েছে। শহীদদের পরিবারের লোকজন অভিযোগ করে জানিয়েছে, প্রতিবছর বংশীতলা দিবস ও বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে শহীদদের কবরে সম্মান জাননো হয়। বিশেষ দিনেই শহীদরা শ্রদ্ধা পায়,তাছাড়া অন্য কোন সময় তাদের কথা কেউই মনে রাখেনা। কবরগুলোকে আরও সংস্কার করার জন্য প্রতিবছরই অনুদান আসে কিন্ত একশ্রেণীন মানুষ তা আত্মসাত করায় শুধু মাত্র পাকা নির্মাণেই কোন ভাবে আটকে আছে ৮ শহীদের কবর। শহীদদের পরিবারের লোকজন আপে করে বলেন, যাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে এ স্বাধীন দেশ,অথচ তাদের প্রতি অবহেলা আর অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই জোটেনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন