সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

স্বরণোৎসবের সমাপনী দিনের আলোচনায় সচিব বরুণ দেব মিত্র, লালনের গান স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এক মহামিলন ঘটিয়েছে

আরিফ মেহমুদ ॥ খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের খাদ্য সচিব বরুণ দেব মিত্র বলেছেন, বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ আধ্যাত্মিক সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে সত্য ও জাতহীন সমাজ গড়তে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি এক বিশ্ব মানব। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগেও তিনি মানুষের হৃদয়ের মাঝখানটা দখল করে আছেন। তাঁর গানের সুর আর কর্ম হোক আজকের যুগের চলার প্রেরণা। লালন শাহ সকল ধর্মের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে সদা সত্য পথে চলতে মানুষকে মানতাবাদীর পথে ডাক দিয়ে ছিলেন। তিনি অহিংস মানবতার ব্রত নিয়ে অসংখ্য গান সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর এই অমর সৃষ্টি সঙ্গীত কোন ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সকল ধর্মের উর্ধে থেকে মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ মানব মুক্তির জন্য সৃষ্টি করেছিলেন ফকিরী মতবাদ। বাউল সম্রাটের সার্বজনিন বাউলতত্বের গান স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এক মহামিলন ঘটিয়েছে। তার মানব দর্শন আজ আর কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ী তথা এদেশের মধ্যে আবদ্ধ নেই। তার সহজিয়া ফকিরী মতবাদের জাতহীন মানব দর্শন ও সঙ্গীত সার্বজনিন বিদিত বিশ্বাঙ্গনে। সভ্যতার এই যুগে মানুষ মানুষে হিংসা বিদ্বেশ ভূলে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ধর্ম দর্শনের চিরাচরিত ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’ আমার মনেরে বুঝায় কেমনে’ মিলন হবে কত দিনে এই শ্লোগানকে বাস্তবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে হবে। গতকাল রবিবার রাতে ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ীতে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসন ও লালন একাডেমির আয়োজনে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ৫ দিনব্যাপী স্মরণোৎসবের সমাপর্নী দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মহিউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) খন্দকার আজিম আহমেদ, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের অধ্য প্রফেসর বদরুদ্দোজা, চাপড়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস। প্রধান আলোচক হিসেবে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র ফকিরীবাদ বাউলতত্বের দর্শন ও আধ্যাত্মিক ভাবসঙ্গীতের বিষয় তুলে ধরে বিস্তারিত আলোচনা করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর বিশিষ্ট লালন গবেষক ড.আবুল আহসান চৌধুরী। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মানিকহার রহমান। আলোচনা শেষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রকাশিত বাউলদের জীবন-বৃত্তান্ত মূলক বইয়ের মোড়ক উম্মোচন ও লালন সঙ্গীত প্রতিযোগীতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন প্রধান অতিথি। এবারের স্বরণোৎসবের অনুষ্ঠানে আসা দেশ-বিদেশের লাখ ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরুদের চরণ ধূলায় সিক্ত বাউল সম্রাটের ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ী। সাঁইজির মতাদর্শের ধর্ম আর জাতি ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কল্যাণে মানুষ নিবেদিত থাক চিরকাল এবং মানবতার নিগুড় প্রেমের ভাবধারা বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ভক্তকুলের এই অঙ্গীকার-সভ্যতার এই যুগে মানুষ মানুষে হিংসা বিদ্বেশ ভূলে সাঁইজির ধর্ম দর্শনের চিরাচরিত ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’ আমার মনেরে বুঝায় কেমনে’ মিলন হবে কত দিনে এই শ্লোগানকে বাস্তবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখবো। মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের অহিংস মানবতা ও ফকিরী মতবাদের জাতহীন মানব দর্শন ও সঙ্গীত দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বাঙ্গনে নিজের মহিমায় জায়গা করে নিলেও বাংলা ভাষা ব্যাতিত অন্য কোন ভাষায় প্রকাশ, প্রচার ও প্রসার ঘটেনি তেমন একটা। মানবতা মুক্তি ও ভক্তির পথকে প্রতিষ্ঠা করতেই তিনি হাজারো ভাবধারার গান সৃষ্টি করছেন। কিন্তু তা বিশ্ববাসীকে নাড়া দিতে পারেনি যথার্থ একাডেমিক প্রচার আর প্রকাশনার অভাবে। তিনি অতি কঠিন কথাগুলো খুব সহজ করে তার গানে বলে গেছেন। তাঁর অমর সৃষ্টি সঙ্গীত গতানুগতিক ভাবে প্রচার ও প্রকাশ হলে চলবেনা। বিশ্বের বিশিষ্ট গবেষকেরা লালনের সৃষ্টি আরো নতুন নতুন তথ্য জানতে চাই। প্রধান আলোচক বিশিষ্ট গবেষক প্রফেসর ড. আবুল আহসান চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ বাঙালী সংস্কৃতির এক মহান প্রতিনিধি। বাংলা সংস্কৃতির মূল ধারা লোকসংস্কৃতি। এই ধারাকে যারা পুষ্ট করেছে ফকির লালন তাদেরই একজন। সম্প্রদায় সম্প্রীতি ও ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ফকিরীবাদ বাউলতত্ব মানুষের প্রধান দর্শন। বাঙালী সংস্কৃতির মহান প্রতিনিধি লালন ফকির, গানে ও সাধনায় তার দর্শণে সেই মানবিক মূল্যবোধে সেই সামাজিক চেতনায় গভীর, লালন ফকির একই সঙ্গে মরমী এবং দ্রোহী, তার গানের ভেতর দিয়ে বাউল সাধনার নানা প্রসঙ্গ অনুসৃত হয়েছে। তার গানের ভেতর দিযে সমাজের অসঙ্গতি, কুপ্রথা সকল জাতপাতের ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। লালন তার গানের ভেতর দিয়ে এমন এক ভূবন সৃষ্টি করেছেন, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, পাখি কমনে আসে যায় এই গানটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাংঘাতিকভাবে নাড়া দিয়েছিল। সাঁইজির সহজিয়া ফকিরী মতবাদের জাতহীন মানব দর্শন ও সঙ্গীত দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বাঙ্গনে। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র অমরত্বের জন্যই কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া এখন বিশ্ব মরমীর তীর্থ কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে লালন মঞ্চে বিভিন্ন শিল্পি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে লালন সংগীতি পরিবেশিত হয়। এতে সংগীত পরিবেশন করেন কোজআপ তারাকা খ্যাত রিংকু সহ দেশের খ্যাতিনামা শিল্পীবৃন্দসহ লালন একাডেমীর স্থানীয় শিল্পিরা। ৫দিনব্যাপী স্বরণোৎসবের অনুষ্ঠানমালার সার্বিক পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন কবি শুকদেব সাহা, খন্দকার লুৎফর রহমান, সুমাইয়া খানম ইভা ও সৈকত মাহমুদ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন