বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

কুষ্টিয়ায় শুরু হয়েছে ৫ দিনব্যাপী লালন সাঁইয়ের ১২৩তম স্মরণোৎসব

এ.এইচ.এম.আরিফ,কুষ্টিয়া ॥ মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই বাঙালির চেতনায় এক অবিস্মরণীয় কালপুরুষ। তাঁর গানের মাঝেই লুকিয়ে আছে সৃষ্টির রহস্য। সৃষ্টিকর্তার সাথে আত্মিক সম্পর্ক তাঁর গানের মূলমন্ত্র। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে একই স্রোতধারায় আনার জন্য আমরণ কাজ করেছেন এই মরমী সাধক। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের সঙ্গীত আজও আমাদের অনুপ্রানিত করে। এই মহান সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১২৩ তম স্মরণোৎসব উপলক্ষ্যে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ীতে গতকাল মঙ্গলবার ২৬ মাচ থেকে শুরু হয়েছে ৫ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। এবার স্মরণোৎসব আর ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস একই দিনে হওয়ায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় আলোচনা সভা বাদেই সরাসরি সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই শেষ হবে শুরুর দিনের অনুষ্ঠানমালা। তবে দ্বিতীয় দিনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকছে পূর্নাজ্ঞতা। যথারিতী উদ্বোধনী আলোচনা সভা ও নির্ধারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাঁইজীর জীবদ্দশায় তার ভক্ত অনুরাগী শিষ্যরা স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান খুব জাকজমক ভাবে উৎযাপিত করতেন। এবারো তার কোন ব্যতিক্রম হচ্ছে না। স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানকে ঘিরে ইতোমধ্যে লালন একাডেমি ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন নানান উদ্যোগ গ্রহণ সহ সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। লালন সাঁইয়ের মাজারের সাজসজ্জা ও ধোয়া-মোছার কাজ শেষ করে সাঁইজীর পছন্দের সাদা ধূসর রং দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছে তাঁর মাজার। স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানে এবার কোন পন্সারের নাম শোনা না গেলেও যথারিতী সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় কুষ্টিয়া লালন একাডেমি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন করবে স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান। সত্য সু-পথের সন্ধ্যানে মানবতার দিক্ষা নিতে আত্মার টানে দেশ-বিদেশের সাধু-গুরু ও ভক্তরা দলে দলে আসতে শুরু করেছে সাঁইজির মাজারে। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী প্রতিবার দুই অথবা তিনদিনের এ উৎসব পালিত হলেও গতবারের স্মরণোৎসব থেকে এবং আগত বাউলদের অনুরোধেই তা বাড়িয়ে পাঁচদিনের প্রথা চালু করা হয়েছে। এবারো তার ভিন্নতা নেই। বাউল সম্রাটের ১২৩ তম স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানমালা সাজানো হয়েছে ৫ দিনব্যাপী। মূল উৎসব শুরু হওয়ার ৭-৮ দিন আগ থেকে আখড়ায় আসা বাউল সাধকরা মাজারের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে আসন গেড়ে গেয়ে চলেছে সাঁইজির আধ্যাত্মিক মর্মবাণী ও ভেদ তথ্যের গান। জমজমাট এখন লালন শাহের আখড়া বাড়ি। কুষ্টিয়া পরিণত হয়েছে উৎসবের শহরে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় ও লালন একাডেমীর আয়োজনে আজ মঙ্গলবার ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়ে একটানা ৩০ মার্চ পর্যন্ত ৫ দিনব্যাপী বাউল সম্রাট সাধক ফকির লালন সাইয়ের ১২৩ তম স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান চলবে। কালী নদী তীরবর্তী লালন মঞ্চের সামনে আয়োজন করা হয়েছে গ্রামীণ মেলার। বিভিন্ন স্টলের পাশাপাশি থাকছে শিশু বিনোদনেরও ব্যবস্থা। অনুষ্ঠানে আগত বাউল সাধুদের গোসলের সুব্যবস্থা করতে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক কালী নদীতে একটি সুন্দর ঘাট ও অনুষ্ঠানে বাড়তী আকর্ষণ যোগাতে বাউল সম্রাট মরমী সাধক ফকির লালন শাহের বিশাল আকৃতির মুরাল ও মুর্তি নির্মাণ করেছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় উন্মুক্ত মঞ্চে বিশিষ্টজনদের মুক্ত আলোচনা শেষে গভীর রাত অবধি চলবে খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিবেশনায় লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান। সুষ্ঠুভাবে আয়োজন সম্পন্ন করতে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশের পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে থাকছে র‌্যাব ও সাদা পোষাকে গোয়েন্দা পুলিশ। স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানে আসা দেশ-বিদেশের লাখ ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরুদের চরণ ধূলায় সিক্ত হবে বাউল সম্রাটের ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ী। সাঁইজির মতাদর্শের ধর্ম আর জাতি ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কল্যাণে মানুষ নিবেদিত থাক চিরকাল এবং মানবতার নিগুড় প্রেমের ভাবধারা বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ভক্তকুলের এই অঙ্গীকার। সভ্যতার এই যুগে মানুষ মানুষে হিংসা বিদ্বেশ ভূলে সাঁইজির ধর্মদর্শনের চিরাচরিত‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’ ও মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি এই শে¬াগানকে বাস্তবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে হবে। উদ্বোধনী দিনে ২৭মার্চ কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কুষ্টিয়া-৪ (খোকসা-কুমারখালী) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য বেগম সুলতানা তরুন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহিদ হোসেন জাফর, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ ইফতেখার মাহমুদ, ই’বির উপ-রেজিষ্টার শামসুর রহমান বাবু, আলোচক হিসেবে থাকছেন বিশিষ্ট গবেষক ম.মনির-উজ-জামান, স্বাগত বক্তব্য রাখবেন কুমারখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন লালন একাডেমির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক মঞ্জু। উলে¬খ্য,বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে, মানুষ গুরুর দিক্ষা দিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র আবির্ভাব ঘটে কুমারখালির ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজো অজানায় রয়ে গেছে তাঁর জন্ম রহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আর্থিক অসংগতির কারনে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত। যৌবনকালে পূর্ণ লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমনে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপান্তর ও সাধন জীবনে প্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহ’র আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি সাধক ফকিরী লাভ করেন। প্রথমে তিনি কুমারখালির ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের একটি আমগাছের নীচে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন। লালন ভক্ত মলম শাহ আখড়া তৈরীর জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতে ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে। প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরী করা হয়। সেই ঘরেই তাঁর সাধন-ভজন বসতো। ছেঁউড়িয়ার আঁখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিষ্যভক্তদের নিয়ে পরিবৃত থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক বাউল সম্রাট দেহত্যাগ করেন এবং তাঁর সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়। আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে লালন মঞ্চে বিভিন্ন শিল্পি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হবে লালন সঙ্গীত। এতে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন দেশের খ্যাতনামা শিল্পীবৃন্দসহ লালন একাডেমীর স্থানীয় শিল্পিরা। উৎসবকে ঘিরে পুরো একাডেমি চত্ত্বরে শুরু হয়েছে খন্ড-খন্ড স্থানে গানের আসর। এসব গান শুনে আগত দর্শক-শ্রোতারাও নেচে-গেয়ে গানের সাথে সাথে তাল মিলাচ্ছে। স্মরণোৎসবের ৫দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সার্বিক উপস্থাপনা ও পরিচালনা করবেন কবি শুকদেব সাহা ও সুমাইয়া খানম ইভা।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন