শনিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৩

কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষপুর্তি উৎসবে অর্থমন্ত্রী মুহিত

আরিফ মেহমুদ ॥ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্যিকার অর্থেই বিশ্বের কবি ছিলেন। তাঁর লেখা আমাদের জাতীয় জীবনে দারুনভাবে প্রভাব ফেলেছে। তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে বাঙ্গালীকে যুগিয়েছে সংগ্রামের সাহস। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ও স্বদেশী হবার যে প্রেরণ পেয়ের্ছিলেন,তা এই শিলাইদহ থেকেই। নোবেল বিজয়ের শতবর্ষের এ অনুষ্ঠান বাংলাভাষা ভাষী ও সংস্কৃতিমনা দুই বাংলার জনগনের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন আরো সৃদৃঢ় করবে। গীতাঞ্জলির বেশির ভাগ রচনাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জল-হাওয়ায় অবস্থান করে। তার লেখা বেশির ভাগ ও প্রসিদ্ধ গান গীতাঞ্জলিতে স্থান পেয়েছে আপন মহিমায়। বাংলার প্রকৃতি ও রূপ, ভাবরস, মানুষের নিত্যবেদনাবোধ, মৃত্যুর অনিবার্যতা,ঈশ্বরের প্রতি আস্থা রবীন্দ্রনাথকে টেনেছিল বিশেষভাবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলী’তে নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার বিকেলে উৎসবমুখর পরিবেশে কবির স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী চত্ত্বরে আয়োজিত বাংলাদেশ ও ভারতীয় শিল্পীদের সমন্বয়ে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য ‘রবীন্দ্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি সকল বাংলাভাষী এবং সংস্কৃতিমনা ব্যাক্তিদের। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সরকারের রয়েছে তবে এ সংক্রান্ত এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে তার বক্তব্য শেষ করে। দুইদিনব্যাপি উৎসবের উদ্বোধন হয় কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে।  গীতাঞ্জলি ১০০ শিরোনামে বাংলাদেশের ‘অতন্দ্র একাত্তর’, ভারতের ‘ফ্রেন্ডস্ অব বাংলাদেশ, এবং বাংলা একাডেমীর যৌথ আয়োজনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে অতন্দ্র একাত্তরের আহবায়ক বেলাল চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য বেগম সুলতানা তরুন, সংশি¬ষ্ট বিষয়ের ওপর  আলোচনা  করেন  বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা, ভারতের বিশিষ্ট চিত্রাকর শুভ প্রসন্ন ভট্টাচার্য, ভারতীয় উপ-হাইকমিশনার সন্দ্বীপ চক্রবর্তী, কলকাতার কবি বিথী চট্টপাধ্যায়, রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়, ভারতের লেখক প্রকাশক ত্রিদিব চট্টপাধ্যায়, অতন্দ্র একাত্তর’র যুগ্ম-আহবায়ক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সদস্য সচিব মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, যুগ্ম-সচিব জয়ন্ত আচার্য প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন। অনুষ্ঠানকে ঘিরে শিলাইদহের কঠিবাড়িতে বসে বই মেলা ও পিঠা উৎসব। আয়োজনকে ঘিরে শিলাইদহে ছিল সাজ সাজ রব। মূল অনুষ্ঠান বিকেলে থাকলেও সকাল থেকেই রবীন্দ্রপ্রেমী দর্শক-শ্রোতদের সেখানে সকাল থেকেই ছিল উপচেপড়া ভীড়। পদ্মার তীরবর্তী সবুজ বন-বনানী ঘেরা শিলাইদহ এ গ্রামটি বিশ্ব কবির হৃদয়ে কাব্যভাবের স্পন্দন জাগিয়ে ছিলো। শিলাইদহে বসেই তিনি রচনা করেন ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ, কিংবা ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, প্রভৃতি সঙ্গীত ও কবিতাসহ অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ। ‘গীতাঞ্জলী’র কাব্যরসও যে তিনি এখান থেকেই পেয়েছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর গ্রন্থ সেই গীতাঞ্জলী প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১০ সালে। সেটা ছিল ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। বাংলা ও ইংরেজি বর্ষ অনুযায়ী পূর্ণ হয়েছে গীতাঞ্জলী প্রকাশের শততম বার্ষিকী এবং চলতি বছর পূর্ণ হলো গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়ের শতবর্ষও। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, দেশটা ৭৫’সালে বেদখল হয়ে গেলো। জাতির পিতার চেতনাকে নির্বাসনে পাঠানো হলো। তাকে হত্যা করা হলো। অনুরুপভাবে সেসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও নির্বাসনে পাঠানো হলো। কণ্যার হাত ধরে জাতির পিতার আজ আগমন ঘটেছে নিজ ভূমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আজ স্বমহিমায় প্রতিস্থাপিত। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ আধুনিক হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলেন বিশ্ব থেকে ও শিলাইদহের পদ্মার পাড় থেকে। সামরিকতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতন্ত্র থেকে বর্তমানে আমরা গণতান্ত্রিক উত্তেরণে এগিয়ে চলেছি। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ নান্দনিককতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি ছিলেন আন্দোলন সংগ্রামের অনুপ্রেরণার কবি। কবির এই আন্দোলন- সংগ্রামের অনুপ্রেরণা থেকেই আসুন আমরা এ বাংলা থেকে যুদ্ধাপরাধী জঙ্গীবাদকে চির বিদায় জানাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক সাথে কাজ করি। ভারতীয় উপ-হাইকমিশনার সন্দ্বীপ চক্রবর্তী বলেন, রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালির নয়, বিশ্বমানবতার কবি। রবীন্দ্রনাথকে আপনারা যুদ্ধ করে পেয়েছেন। সেই যুদ্ধকে আমি সেলাম করি। বাংলা ভাষার যে স্ট্যান্ডার্র্ড, বাংলাদেশে দেখেছি পশ্চিমবঙ্গে তা নেই।
সভাপতির বক্তব্যে বেলাল চৌধুরী বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, বাঙালি জাতির সহস্রাধিক বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য অন্য সমস্ত পরিচয়কে ছাড়িয়ে গেছে, আমরা বিশ্বাস করি সাহিত্য শিল্প-সংস্কৃতির কোনো ভৌগলিক সীমানা নেই। তিনি বলেন আমরা বিশ্বাস করি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-মাইকেল-বঙ্কিম-জীবনানন্দ-লালন অবিভাচ্য। তিনি বলেন, তাই আমাদের এই প্রয়াস দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারি মানুষের বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্যই শুধু নয়-রবীন্দ্রনাথ তথা বাংলাকে এদেশের মানুষের অন্তরের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টাও বটে।
গবেষকদের মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারিত্বের ভারপ্রাপ্ত হয়ে শিলাইদহে আসেন ১৮৯২ সালে। এসময় পদ্মার বুকে পাল তোলা নৌকা, বকুলতলার শান বাঁধানো ঘাট, একটু দূরে গড়াই নদী ছাড়াও গ্রাম বাংলার সবুজের সমারোহ ভরা শিলাইদহ তাঁকে করেছিল বিশেষভাবে আকৃষ্ট। কবিগুরু শিলাইদহে ছিলেন ১৯২২ সাল পর্যন্ত। এই সুদীর্ঘ এই সময় এখানে অবস্থানকালে তিনি সৃষ্টি করেছেন সহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাঁর শিলাইদহে রচিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে; সোনারতরী, চৈতালী, ক্ষণিকা, চিত্রা, গীতাঞ্জলী, কথা ও কাহিনী, গীতিমালা, বলাকা, চিরকুমার সভা, চিত্রাঙ্গদা, গল্পগুচ্ছ, পঞ্জভূতের ডায়েরী, জীবন স্মৃতি ও কল্পনা ইত্যাদি। উলে¬খ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে অবস্থানকালে গীতাঞ্জলী লিখে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্র গবেষকরা মনে করেন, গীতাঞ্জলীতে সুরেরই আধিক্য বেশি। সুর ও বাণীর অপূর্ব মূর্ছনা নিয়েই গীতাঞ্জলি। গানগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই আধ্যাত্মিক। আপাত মনে হয়, কবি মানব-মানবীর প্রেম-বিরহ-মিলনের কথা বলছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার, মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রেম-বিরহ-মিলনের কথা। অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড.গহর রিজভী, এ্যর্টনী জেনারেল মাহবুবে আলম, সাংবাদিক আবেদ খান, বিশিষ্ট চলচিত্রকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী, ভারতের ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের কার্যকরী সভাপতি রাধাতমাল গোস্বামী, সহ-সভাপতি সত্যম রায় চৌধুরী, বিদ্যুৎ দেবনাথ কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহমেদ প্রমূখ। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সন্ধ্যায় রামাদিত্য রায়, মলি¬কা মজুমদার ও শারমিন লাকী উপস্থাপনায় এবং রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়’র ধারা বর্ণনায় সাংবাদিক আবেদ খানের পরিচালনায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রখ্যাত শিল্পীরা। এদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের ফাহিম হোসেন চৌধুরী, মহিউজ্জামান চৌধুরী ময়না, লিলি ইসলাম, বুলবুল ইসলাম, তানিয়া মান্নান, সুস্মিতা আহমেদ বর্না, ও শারমিন সাথী ময়না প্রমুখ এবং ভারতের ইন্দ্রনীল সেন, শান্তুনু রায় চৌধুরী, প্রমীতা মলি¬ক, মৌসুমী রায় চৌধুরী, শুভ্রনীল চট্টোপাধ্যায়, ইমন চক্রবর্তী ও লকেট চ্যাটার্জী। এ ছাড়া দুই বাংলার আবৃতি ও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের লায়লা আফরোজ, ডালিয়া আহমেদ, শিমুল মুস্তফা ও ঝর্ণা সরকার এবং ভারতের সত্যম রায় চৌধুরী ও মল্লিকা মজুমদার। যন্ত্রসঙ্গীতে বাংলাদেশের এনামুল হক ওমর, সুনীল সরকার, ইউসুফ খান ও অসিত বিশ্বাস এবং ভরতের অনুপম মলি¬ক, কুনাল চক্রবর্তী, নির্মল কুমার মজুমদার, শক্তিপদ দাস ও বিশ্বরূপ নাথ। এ উপলক্ষে কুঠিবাড়ি চত্বরে বসে দিনব্যাপী পিঠা উৎসব ও বই মেলা। পিঠা উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সহধর্মিনী আফরোজা হক রিনা। নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ উদযাপনের দ্বিতীয় দিনের রবীন্দ্র উৎসব অনুষ্ঠিত হবে আজ শনিবার ঢাকা বাংলা একাডেমী চত্ত্বরে।


 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন